বাবা হওয়ার দুঃখ
মাগরিবের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফেরার সময় রাস্তায় হোঁচট খেয়ে মজিবর সাহেবের ডান পা টা কচকে যায়। বুড়ো মানুষ। এমনিতেই লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁটেন তিনি।পা কচকে যাবার পর তিনি আর উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। তাকে ধরে দাঁড় করালো হানিফ মিয়া।হানিফ মিয়া তাকে ধরে ধরে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল । বাড়িতে পৌঁছার পর মজিবর সাহেবের মেজো ছেলের বউ এসে একদফা বকে গেলো তাকে। বললো,'আব্বা, আপনার কী মাথায় কোন ঘিলু টিলু নাই নাকি? আপনার ছেলে বারবার না করে নাই এমন শরীর নিয়া মসজিদে যায়তে? তাইলে গেলেন কেন? এখন আপনার ছেলে যদি জিজ্ঞেস করে তাইলে জবাব কী দিবেন? পারবেন কিছু বলতে?'
মজিবর সাহেব তার পুত্র বধুর কথায় জবাব দিলেন না।তার পায়ে অসম্ভব ব্যথা,কাদাও লেগে আছে একটু।কাদাটা পরিষ্কার করে একটু তেল টেল মালিশ করলে আরাম পাওয়া যেতো। কিন্তু এই কথা বলার সাহস তিনি পাচ্ছেন না। মজিবর সাহেবের তিন ছেলে। তিন ছেলেকেই তিনি পড়াশোনা করিয়ে উচ্চ শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলেছেন।বড় ছেলে আনোয়ার স্ত্রী সহ ইংল্যান্ডে থাকে।তারা তিন বছরে একবার বাড়ি আসে। মজিবর সাহেবের সাথে আনোয়ারের কথা খুব একটা বেশি হয় না।মাস খানেক পর পর হঠাৎ কোন বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন হলেই কেবল আনোয়ার ফোন দেয়।ফোন দিয়েও কী আর সে নরম গলায় কথা বলে।বলে না। বাবাকে সামান্য কারণেই সে ধমকে দেয়।আজ ফোন দিয়েও ঠিক এই কাজটাই করলো।বললো,'আব্বা, আপনার কী লাজ লজ্জা মরণের আগে আর কোনদিন হবে না?'
'মজিবর সাহেব চমকে উঠে বললেন,'কী বলতাছস এইসব আনু?'
'বলতেছি আপনি এমন বেলাজ কেন?এই যে তিরিশ হাজার বার করে না করলাম আপনারে মসজিদ টসজিদে যাওয়ার প্রয়োজন নাই আপনার, তবুও গেলেন। এখন যে পা ভাঙছেন এই পা ঠিক হয়বো কেমনে?'
মজিবর সাহেব কিছু বললেন না। তিনি চুপচাপ মোবাইলের লাল বাটনে আলতো করে একটা চাপ দিয়ে দিলেন।
খানিক পর আরেকটা ফোন আসলো মজিবর সাহেবের মোবাইলে।তার ছোট ছেলে সৌরভ। সৌরভ একটা প্রাইভেট ব্যাংকের উপজেলা শাখার ক্যাশ ম্যানেজার। স্ত্রী সহ সে থাকে টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানায়। সৌরভ ফোন দিয়ে বলল,'আব্বা আসসালামুয়ালাইকুম।'
মজিবর সাহেব সালামের উত্তর দিলেন। সৌরভ খানিক সময় চুপ থেকে বললো,'আব্বা, আপনার সমস্যা টা কী শুনি?'
'এই কিছু না বাজান, পায়ে একটু হোঁচট খাইছি।'
'এইটা কিছু না কেমনে আব্বা? ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে কত লাগবো আপনি জানেন? জানেন না। জানবেন কেমনে?টাকা তো আপনার পকেট থেকে বের হয় না আব্বা।টাকা বের হয় আমাদের পকেট থেকে।'
মজিবর সাহেবের ইচ্ছে করছিল ছেলেকে কিছু বলতে। কিন্তু বলার সুযোগ তিনি পেলেন না।তার আগেই কুট করে ও পাশ থেকে লাইনটা কেটে দিল সৌরভ।কী অসম্ভব এক ব্যপার। মজিবর সাহেবের পায়ের ব্যথার কথা কেউ আর ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে না।সবাই শুধু বকছে, তার দোষ দিচ্ছে। কিন্তু দোষটা আসলে কার? কপালে দুঃখ থাকলে তা সাড়ানোর উপায় কী! মজিবর সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না।
রাত দশটার পর মেজো ছেলে তরিকুল ইসলাম ঘরে ফিরলো। তরিকুলের ধানের বড় আরত আছে।বড় ব্যবসা।সেই ব্যবসা গুটিয়ে আসতে তার অর্ধ রাত হয়। কিন্তু বাবার অসুখের কথা শুনে আজ দশটা বাজতেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে।তার হাতে এন্টি বায়োটিক ট্যাবলেট।আসার সময় ফার্মেসি থেকে নিয়ে এসেছে। বাবার ঘরে ঢুকে সে সেই ট্যাবলেটের প্যাকেটটা খাটের পাশে রেখে বাবার পাশে দু মিনিট বসলো। বসে বললো,'আব্বা, আমার উপর আর কত আজাব দিবেন কন তো?ছেলে তো আর আমি একলা না। কিন্তু আজাব টা আমার উপর একলা কেন?নাকি আমারও বাড়ি ছাইড়া চলে যেতে হয়বো?'
তরিকুল কথাগুলো বলে বাবার সামনে থেকে খস খস করে হেঁটে চলে গেল। মজিবর সাহেব খেয়াল করলেন তার চোখ টলমল করছে, কিন্তু পায়ের ব্যথাটা এখন আর নাই। কিন্তু মনের ভেতর একটা সূক্ষ্ম অথচ চিনচিনে ব্যথা।ব্যথাটা তীব্র থেকে আরো তীব্রতর হচ্ছে। মজিবর সাহেবের পায়ে এখনও কাদা লেগে আছে।কাদা নিয়েই তিনি কম্বলের ভেতর ঢুকে গেলেন।তার ট্যাবলেট খাওয়া উচিত কিন্তু তিনি ট্যাবলেট খেলেন না।তার শুধু মনে হচ্ছে সেই পুরনো দিন গুলোর কথা।
তখন এই তরিকুল ছোট। প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। স্কুলে খেলতে গিয়ে পায়ে কাঁচের টুকরো বিঁধিয়ে ফেলে।দরদর করে রক্ত বেরিয়ে পড়ে ছেলের পায়ের ক্ষত থেকে। মজিবর সাহেব ঘটনা দেখে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা। তখন আজকালকার মতো এতো গাড়ি ঘোড়ার ব্যবস্হা নাই। তিনি ছেলেকে কাঁধে করে পাঁচ মাইল হেঁটে বারহাট্টা নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে।আর এই ছেলে এসে তার পায়ের আঘাতটার কথাও পর্যন্ত জানতে চায়লো না। উল্টো তার উপর তিনি জুলুম করছেন কি না বলে গেল! ছিঃ! মজিবর সাহেবের মাথাটা কেমন লাটিমের মতো ভণ ভণ করে ঘুরে উঠলো।
মজিবর সাহেবের আরো কিছু বিষয় মনে পড়ছে। তিনি তখন হাইস্কুলের সামান্য কেরানি।অল্প বেতন।এই বেতনে তিন ছেলের পড়ার খরচ চলেনা বলে তিনি তার জমি বিক্রি করতে লাগলেন। আস্তে আস্তে তার সব জমি শেষ হয়ে গেল। শেষ মেশ ঘরের জায়গাটাও।আনোয়ারের ইংল্যান্ড যেতে অনেক টাকার প্রয়োজন।বাড়ি ঘর বেছে দিয়ে ছেলেকে তিনি ইংল্যান্ড পাঠালেন। অবশেষে নিঃস্ব তিনি দিনরাত খেটে কুটে ছোট ছেলে দুটির চাকরি বাকরি,ব্যবসার ব্যবস্হা করলেন। ছেলেরা চাকরিজীবী হয়ে অনেক জায়গা জমি করলো,ঘর দোর করলো পাকা। কিন্তু এতে লাভ কী হলো মজিবর সাহেবের? মজিবর সাহেবের গলা ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। তিনি বড় কষ্ট করে তার বিছানার পাশের দখিন মুখি জানলাটা খুললেন।জানলার ও পাশে থালার মতো বড় চাঁদ। কাঁঠাল পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে সেই চাঁদের হলুদ জোছনা। মজিবর সাহেব সেই ছোছনা ভেজা কাঁঠাল পাতার দিকে তাকিয়ে হো হো করে কেঁদে উঠলেন।
Comments