top of page
Writer's pictureJust Another Bangladeshi

অন্যরকম অবলম্বন

" মা, শোন, সংসারে থাকতে গেলে স্বামী স্ত্রীর খুনসুঁটি একটু হয়ই। সেইটা এইরকম মনে নিয়ে বসে থাকতে হয় না। তার ওপর তোমার নতুন বিয়ে। এত তাড়াতাড়ি তো শ্বশুরবাড়ি আরো ছাড়তে হয়না। তোমার চাচিকে দেখো,বিয়ে হয়েছে বিশবছর,বিয়ের দ্বিতীয় দিন থেকে এখন পর্যন্ত দুইবেলা নিয়ম করে ঝগড়া করে, কই বাপের বাড়ি তো আর যায় না।"


নিতু মাথা নিচু করে বসে ছিলো, ওবায়দুল চাচা দেখতে পেলে বুঝতেন মেয়েটার মুখটা তার মুঠো করা হাতের মত শক্ত হয়ে আছে। এই তিনদিনে লোকটাকে নিয়ে পাঁচ নাম্বার হলো মানুষ তাকে উপদেশ দিতে আসছে। গতকাল এলেন উপরতলার শিরিন বানু যার স্বামী কিনা গতবছরই দুইনাম্বার বিয়ে করে অন্যখানে ঘর পেতেছেন। দুই সংসার টানেন, মাসের বিশদিনই নতুন বউয়ের কাছে থাকেন। শিরিন বানুর কাজ হচ্ছে স্বামীর টাকায় কেনা তরকারি চুলায় চাপিয়ে দুইদিন পর পর মায়ের কাছে আসা এবং তিনি ঐ নতুন বউয়ের থেকে কত সুন্দরী এবং গুনবতী সেটা বোঝানো। "বুঝলেন ভাবি, মেয়ে তো না, কালনাগিনী এক! আপনার ভাই বোকাসোকা মানুষ, বোঝে নাই, ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনে গলে গেছে! এখন বুঝছে ঐ শুটকির সাথে সংসার করতে কি জ্বালা!"

নিতুর মনে হয়না আনিসুর চাচা কোন জ্বালায় আছেন, গত সপ্তাহতেই মাছের বাজারে দেখা হলো মানুষটার সাথে। ঝলমলে হাসিমুখ করে মাছওয়ালার সাথে দরদাম করছিলেন। নিতুকে দেখতে পেয়ে দূর থেকেই হাসিমুখে হাত নাড়লেন। তাড়া ছিল বোধহয়, নাহলে এগিয়ে আসতেন ঠিক। মানুষটা বেশ বোকা, তাকে নিয়ে যে মহল্লায় কত কথা হয় সেটা নিয়ে উনার মাথাব্যথা নেই একদম। ভালোই আছেন দুই সংসার মিলে। ঐ বড় চিতলমাছটাও নিশ্চয়ই নতুন সংসারে যাবে!

ওবায়দুল সাহেব সামান্য গলা নামিয়ে বললেন," মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানো মা? তোমার চাচি রাগ করে বাপের বাড়ি গেলেই ভালো হতো, আমিও দুটা দিন আরাম করে শুয়ে বসে কাটাতে পারতাম। উঠতে বসতে তোমার চাচির খ্যানখ্যান শোনা লাগতো না।" সাদা পাঞ্জাবি পরা মানুষটা দুনিয়া কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো, হাসির তালে তালে তার ভুড়িটা কাঁপছে! নিতুর চোখ জ্বলছে, পানি জমছে একটু একটু করে। মাকে অসংখ্যবার বলেছে কেউ তার সাথে দেখা করতে আসলে যেন বলে দেয় সে অসুস্থ! কোনবারেই মা শোনেন না। হয়তো ভাবেন এদের কথায় নিতু আবার ফিরে যাবে ঐ সংসারে!

ওবায়দুল সাহেব হেসেই যাচ্ছেন, উনার হাসির শব্দ শুনে হাসান ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। এই ছেলেটাকে নিতুর মাঝেমাঝে অসহ্য লাগে, ক'দিন পর থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু অথচ কোন বোধবুদ্ধি নেই। এই গতপরশুই ভালো লেগেছে বলে রান্না করা সবকয়টি মাছভাজি এক বৈঠকেই খেয়ে ফেললো, পেঁয়াজ টেঁয়াজ শুদ্ধু। অথচ বাড়ির বাকি তিনজন বাসিন্দা যে সেই দুপুরে তখনো খায়নি সেটা মাথাতেও নেই। মা মিনমিন করে বললেন," থাক ছোট ভাইটা খেয়েছে, খাক একদিন। রোজ রোজ তো খায় না।" মিতু বেচারা শুধু ডাল দিয়ে খেয়েই উঠে গেল। এই মেয়েটাও গাধা, মুখে কোন রা নেই! ঐদিন ডাল না থাকলেও শুধু পানি দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে নিত নিশ্চিত, একটা কথাও বলতো না।

নিতুর এখন সবকিছু অসহ্য লাগে, সবকিছু। দুপুরবেলা হাসান হাত-পা মেলে নাক ডেকে ঘুমায়, সেটাও অসহ্য লাগে! কয়দিন পর পরীক্ষা, এখন এত গা ছেড়ে ঘুমাবে কেন? বোঝে না বাড়ির একমাত্র পুরুষ মানুষ সে? মা তার বড় হওয়ার জন্য হাঁ করে তাকিয়ে আছে? বড় হবে, ইনকাম করবে কত কি! অথচ কেউ কিছু বললে মানসিক প্রতিবন্ধীর মত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিতুর গা রি রি করে রাগে। আবার সেদিন রাতে দেখলো মিতু পড়তে বসেছে, চোখে কাজল। দেখেই নিতুর মেজাজটা গরম হয়ে গেল। পড়তে বসেছিস, পড়, চোখে কাজল লাগিয়ে পড়তে বসা কোন দেশী ধর্ম? এলাকার একটা নামমাত্র কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়ছে মেয়েটা, ভর্তি হয়ে থাকতে হয় বলেই মনে হয় ভর্তি হয়েছে কলেজে। নিতুর ধারণা সে ক্লাসেও যায় না, ক্লাসের নাম করে অন্য কোথাও যায়। সেদিন দেখে সকালে কলেজে যাবে বলে বের হচ্ছে, মায়ের কাছ থেকে রিকশাভাড়াও নিলো অথচ হাতে একটা খাতা পর্যন্ত নেই। এই জৈষ্ঠ্যমাসের প্রচন্ড গরমে চুল ছেড়ে কাজল মেখে সে নাকি কলেজে যাচ্ছে! ইয়ার্কি! নিতু ঠিক করে রেখেছে একদিন সে মিতুকে হাতেনাতে ধরবে। কলেজের নাম করে কোথায় যায়!

নিতু উঠে দাঁড়ালো। ওবায়দুল সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন, তার মনে হয় আরো অনেক কথা বলার ছিলো। রাগ হলে চাচি আরো কি কি করেন। নিতুর মাথা ধরেছে প্রচণ্ড। এই লোকের দানবীয় হাসি সারা মাথা জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। নিতু নিশ্চিত আজ সারারাত ধরে সে এই হাসি শুনবে। মা রান্নাঘরে ছিলেন, ফোঁড়ন দিচ্ছিলেন ডালে। মিতু তারপাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলছিলো। নিতু আসাতে চুপ করে গেল। নিতু একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে মিতুকে বললো, " যাতো এখান থেকে।" মিতু আড়চোখে নিতুকে এক পলক দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ঘরে। এ বাড়ির সবার আচরণ বড্ড বেশি বদলে গেছে। কেউ তার চোখে চোখে তাকায় না। আড়চোখে দেখে, চোখ চোখ পড়লে চট করে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। যেন নিতু এক সাজাপ্রাপ্ত আসামী, অনেক লজ্জার কাজ করে এসেছে। অথচ নিতু কিছুই করেনি, সাজেদের ঘর ছেড়েছে মাত্র।

মা গরম তেলে জিরার ফোঁড়ন দিতে দিতে বললেন," তোর মৌসুমি খালা আমাকে মোবাইল করেছিলেন, তোকে ফোন দিয়ে পাচ্ছেন না নাকি কলব্যাক করতে বললেন।" নিতু কিছু বললো না, সে ইচ্ছা করেই এই মহিলার ফোন ধরেনি। ফোন ধরলেই গালাগাল করে গুষ্ঠি উদ্ধার করে দিতেন। সাজেদের সাথে বিয়ের ঘটকালি উনারই করা, লাখে একটা ছেলে, বাড়ি গাড়ি কি নেই। কাজের লোকই নাকি তিনটা। রাজার মত চেহারা আরো কত কি। এই মহিলার চোখে সাজেদ ফেরেশতা, মদ খায়, গাঁজা খায় বললেও বলবেন," আপার ক্লাস সবাই ই মদ খায়। মদ খাওয়াই বা খারাপ কি? মদ তো মেডিসিন, ওতে কিডনি ভালো থাকে। বুঝিস না তো কিচ্ছু, বাংলা সিনেমা দেখে দেখে মনে করিস মদ মানেই খারাপ।" পরনারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে বললে হাসিমুখে বলবেন," শোন তুই হলি বেকুব, অন্য মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করার ছেলে সাজেদ না। তোকে একটু জেলাস করতে চায় বুঝলি! যেন তুই একটু ফুলিস। ছেলেরা খুব বদমাস হয়, অন্য মেয়ের সাথে দেখায় দেখায় একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে আর চোখ রাখবে বউয়ের দিকে আর মনে মনে মজা পাবে। তুই কিচ্ছু বুঝিস না, বেকুব একটা।"

মায়ের কপালে ঘাম জমছে বিন্দুবিন্দু। হাসানের জন্য এক টোপলা খাসির মাংস বের করা হয়েছে ফ্রিজ থেকে। খাসির মাংস আর ডাল ভাত হবে আজকে দুপুরে। নিতু খাসির মাংস কখনো খায় না, গন্ধ লাগে। মিতু আর হাসানের খুব পছন্দ। নিতু নিশ্বাস ফেলে বললো," আমি ঘরে যাচ্ছি মা, ওবায়দুল চাচা বসার ঘরে বসে আছেন, উনাকে দয়া করে বিদায় করো। মাথা ধরে গেছে আমার।" মা আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে মাথা নাড়লেন। রান্নাঘরের দরজা পেরিয়ে সাথে সাথেই নিতু আবার ঢুকলো রান্নাঘরে। হালকা গলায় বললো," তোমাদের জন্য খানিক মাংস তুলে রেখে তারপর হাসানকে দিও মা, কষ্ট করে রান্না করছো। শুধু ডাল দিয়ে যেন খেতে না হয়।" কথা শুনে মায়ের মুখটা কালো হয়ে গেল, মা বড্ড বেশি ছেলেপাগল। না জানি ছেলে তার কত কত স্বপ্ন পূরণ করবে বলে ভেবে রেখেছেন।

মৌসুমি খালা এলেন সেদিন বিকেলবেলা। মিতু হাসান দুজন পুরো কড়াই মাংস খেয়ে ভাতঘুম দিচ্ছে তখন। শুধু ডালের বাটিটা টেবিলে রেখে মা অপরাধীর মত আড়ে আড়ে তাকাতে লাগলেন নিতুর থেকে। নিতু কিছু বললো না, কি আর বলবে। কাউকে কিছু বলতে গেলেই ভয় হয়, পাছে শুনে ফেলে সে এই পরিবারের আর কেউ না। তার অধিকার নেই কিছু বলার। অথচ বিয়ের আগে তার চাকরির টাকায় সকাল দুপুরের হাড়ি চলতো, হাসান তার ব্র‍্যান্ডের সানগ্লাস কিনতো। মিতু খোলাচুলে সামনে এসে বলতো," আপা কয়টা টাকা দেতো, কলেজে আজ পিকনিক।" তারপর তার বিয়ে হলো, বিয়ের পরে বেতনের টাকা যখন দিতে এলো মায়ের কাছে, মা অদ্ভুত দৃষ্টি করে তাকালেন। যেন নিতু কোন মানুষ না, এলিয়েন। টাকাটা নিতু কতক্ষণ ধরে ঠাঁয় বাড়িয়ে রইলো, মা সেটা ছুঁলেনও না। প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বললেন," মৌসুমি বলছিলো সাজেদ নাকি চায় না তুই চাকরি কর। শোন মা, এসব অনেক তো হলো, এখন বাদ দে। মন দিয়ে সংসার কর। ওইটাই এখন তোর ধর্ম।" নিতুর টাকা ধরা হাতটা গুঁটিয়ে এসেছিলো কথাটা শুনে, "ধর্ম"!! নিতু তর্ক করেনি, শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো," তোমাদের চলবে কিভাবে মা?"

- তোর বাবার পেনশানের টাকাটা তো আসে। তোর বড়মামাও মাসে মাসে কিছু দেবে বলেছে।

নিতু মুখ কুঁচকে গেলো কথাটা শুনে। সারাজীবন মাথা উঁচু করে চলা তাদের পরিবার এখন হাত পাতবে মানুষজনের কাছে? মা বোধ হয় বুঝলেন নিতুর মনের কথাটা, নিজেই তড়িঘড়ি করে বললেন," তোর বাবার কাছ থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছিলো তোর মামা, ঐ ব্যবসাটা দাঁড় করানোর জন্য। ঐটাই ফেরত দেবে এখন মাসে মাসে। অন্য কিছু না।"

নিতুর বিশ্বাস হলোনা কথাটা। বাবার কাছ থেকে মামা টাকা নিয়েছিলো ঠিক, নিতু তখন খুব ছোট। তা সে কত টাকাই বা হবে! বাবা মারা গেছে পনের বছর হলো, এতদিনে টাকা শোধ টাকা শোধ করে করে কত টাকা নেওয়া হলো মামার কাছ থেকে। এতদিনেও কি সে টাকা শোধ হয়নি? এখনও ব্যবসা করে লাখপতি বনে যাওয়া মামা মানুষটা টাকা শোধ দিয়ে যাচ্ছেন?

মৌসুমি খালা ভারি শরীরের মানুষ, পুরনো বিল্ডিং এর উঁচু উঁচু সিঁড়ির দোতলা উঠতেই উনার হাঁফ উঠে গেল। ড্রইংরুমের সোফাটায় ধপ করে বসে পড়েই বললেন,"ফ্যানটা ছাড়তো৷ এই গরমে ফ্যান অফই বা করিস কেন?" নিতু ঘরে ছিল, মিতু কলেজ থেকে ফিরেছে মাত্র। ফিরেই গোসল সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছেছে আধঘন্টা ধরে। চুল মোছার আবার সে কত কায়দা! মাথাটা এদিকে হেলিয়ে, ওদিকে চুল এনে। দেখতে দেখতে নিতুর মনে হলো তার ভালোই লাগছে দেখতে, রাগ হওয়ার কথা ছিল অবশ্য! এমন মাথাভর্তি চুল তারও ছিল একসময়। সাজেদরা দেখতে এলো যেদিন, নিতুর খোঁপা হয়েছিলো এই এত্ত বড়। সাজেদের মামী বসা থেকে উঠে এসে নিতুর খোঁপা খুলে দিলেন, চুল কোমড় ছাড়াতেই মাশ আল্লাহ মাশ আল্লাহ রব উঠলো সবার! মৌসুমি খালা কপট আফসোস করে বললেন," এতে আর কি মাশ আল্লাহ বলেন আপনারা! যত্ন নেয় না বলেই এই, নয়তো মেঝে ছুঁতো এই চুল।" আচ্ছা, তখন মিতুর চুল তো এত লম্বা ছিল না। নাকি ছিল? খেয়াল নেই। অবশ্য পাঁচমাসে চুল লম্বা হওয়ার সময়ও পেয়েছে অনেক। কিন্তু ঘনও ছিল না এত। যত্নও করেছে নিশ্চয়ই। নিতু নিজের অজান্তেই রুক্ষ চুলগুলো একবার ছুঁয়ে নিলো, কতদিন চুলে তেল দেয় না! আগে মা মেহেদি দিয়ে দিতেন মাসে মাসে। বিয়ের পর তো সেটাও হয়না। অথচ শ্বশুর বাড়ির বাগানে মেহেদি গাছটা দেখে নিতু কি খুশিই না হয়েছিলো প্রথমদিন।

ড্রয়িংরুম থেকে খালার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। নিতুর মাঝে মাঝে মনে হয় মহিলার জন্মই হয়েছে চিৎকার করার জন্য বরং এতক্ষণ কেন চিৎকার করেন নাই এটাই অবাক করার কথা!

" শোন রাবু, তোর ঐ মেয়ের অনেক ঢং সহ্য করেছি আমি। কি মনে করেটা কি সে নিজেকে? জীবন নাটক সিনেমা? খুব আত্মসম্মান দেখাচ্ছে সবাইকে! আত্মসম্মান আমাদের নেই? আমরা সংসার করি না? আজকালকার মেয়েরা স্কুল কলেজ পাশ করে আর সিনেমা দেখে দেখে এইসব ঢং শেখে। তোকেও বলিহারি যাই। বিয়ে দিলি মেয়েকে, একটু শেখাবি না কিসু? সংসারের নিয়ম কানুন? সংসারে টিকতে গেলে একটু স্যাক্রিফাইস কম্প্রোমাইজ করতে হয়। এইটা মেয়ের ধর্ম। এইখানে আত্মসম্মান খোঁজে প্রথম শুনলাম আমার এই তিরিশ বছরের সংসারজীবনে।"

মিতুর চুল মোছার বেগ কমেছে। আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে নিতুর দিকে। হাসান নেই বাসায়। প্রাকটিকাল দেখতে গেছে নাকি স্কুলে। নাহলে ঘরের ঐদিক থেকে সেও তাকাতো আড়ে আড়ে। নিতুর তেমন কোন অনুভুতি হচ্ছে না, না কষ্ট, না রাগ, না অভিমান, কিচ্ছু না! ঘুম পাচ্ছে শুধু। চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে। ক্ষুদাও লেগেছে। শুধু ডাল ভাতে পেট ভরেনি, এখন মনে হচ্ছে খাসির মাংশ থাকলে বেশ হতো। ঝাল ঝাল খেতে মন চাচ্ছে।

মা এসে দাঁড়ালেন দরজায়, প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বললেন,"একটু বসার ঘরে আয় মা। খালা কথা বলবেন তোর সাথে।" মায়ের চোখ ছলছলো। নিতু ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো। এতক্ষণ কোন অনুভুতি ছিল না মনে কোন। এখন হচ্ছে, বিচিত্র অপরাধবোধ হচ্ছে একটা। মায়ের এই কান্নাভর্তি চোখের জন্য অপরাধবোধ, মিতুর কলেজে তার বান্ধবীরা নিশ্চয়ই মিতুকে নানান কথা জিজ্ঞেস করে, মিতুর অপমান হয়, সেটার জন্য অপরাধবোধ। আচ্ছা তারও কি খুব দোষ ছিল? সারাজীবন পার করেছে যে মানুষগুলোর কাছে, ভেবেছিলো তাদের কাছেই তার আশ্রয় থাকবে সবসময়। এটা কি খুব ভুল চিন্তা?

ড্রয়িংরুমের ফ্যানটা ঘুরছে ঘটরঘটর করে। এই ফ্যানে বাতাস হয়না বললেই চলে। ফ্যানটা ঘোরে এটাই মনের শান্তি। খালা তার কাতান শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে করতে হাঁসফাঁস করছিলেন। তার আপেলের মত টুকটুকে গালটা লাল হয়ে গেছে আরো। নিতুকে দেখে মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করলেন খানিক। বোনের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললেন,"রাবু তুই ভিতরে যা। তোর আদরের টুকরাটারে আমি এখন কিছু উচিৎ কথা বলবো। তোর সহ্য হবেনা।" মা মাথা নিচু করে কি যেন বললেন, শোনা গেল না। মৌসুমি খালা বোনের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিতুকে এফোঁড়ওফোঁড় করলেন এক দফা। হিমশীতল গলায় বললেন," সাজেদের সাথে তোর সমস্যাটা কি হয়েছে?" নিতু কিছু বললো না। বলার উৎসাহ পাচ্ছেনা সে। কি বলবে? বলে লাভটা কি হবে? সে যাই বলুক, দোষ হবে তারই।

মৌসুমিখালা গলা ঠান্ডা রেখেই বললেন," চুপ করে আছিস কি জন্যে? কাহিনী ঘটার সময় তো তো চুপ ছিলি না, এখন চুপ কেন? এত ভদ্রতা শ্বশুরবাড়িতে দেখাতি। সাজেদ ভুলটা কি করেছে?" নিতুর মুখ ভাবলেশহীন, একহাতে সোফার একটা কোণা ধরে স্থির দাঁড়িয়ে আছে, যেন সে একটা জড় পদার্থ। খালার কথা শেষ হবার অপেক্ষা করছে, শেষ হলেই ঘরে চলে যাবে। ঘুমের জন্যই কিনা কেজানে, চোখদুটো জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে একেবারে। নিতুর স্বাভাবিক মুখ দেখে খালার রাগ আরো বেড়ে গেল, চিৎকার করে উঠলেন তিনি, " তুই ভাবিস কি নিজেকে? প্রধানমন্ত্রী? মানসম্মান নিয়ে টইটম্বুর হয়ে বসে আছিস? মানসম্মান তোর একার আছে? ভার্সিটি পাশের একটা সার্টিফিকেট কি আছে, ছয়মাস একটা চাকরি কি করেছে উনি তাতেই সাপের পাঁচ পা দেখেছে একেবারে। তোরে যে জিন্দা ছেড়ে দিছে তাতেই তোর চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য, আমি হলে তোকে আগুনে পুড়ায় জ্বালায় মারতাম।"

নিতু মায়ের দিকে তাকালো, মা কাঁপছেন থরথর করে। মিতু ঘর থেকে ড্রয়িংরুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে চিরুনি। পাশের ফ্লাটের দরজা খোলার শব্দ এলো বোধহয়। দরজা খুলে দিলে কথা আরো বেশি ভালো শোনা যায়। মৌসুমিখালা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপাচ্ছেন এখন। খালা আর মাকে দেখে কেউ বলবেনা তারা আপন দুই বোন। খালার পাশে মাকে কাঠি কাঠি লাগে। অবশ্য বয়স্ক লাগে মাকে বেশি, চেহারা ভেঙে গেছে একেবারে। আর খালার চেহারা এখনো চকচকে, নিজেই বলেন, রান্নাঘরে যাওয়ার ফুরসত পান না। কাজের মানুষ আছে। নিতু উল্টাপাল্টা চিন্তা ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এলো। কেন জানি এক জায়গায় বেশিক্ষণ মন টেকে না, রাজ্যের কথা মাথায় আসতে থাকে, অপ্রয়োজনীয় কথা, অর্থহীন কথা!

মা নিতুর দিকে তাকিয়ে আছেন। নিতুর মনে হলো মা করুণা ভিক্ষা চাইছেন। অপমান মানুষটা আর নিতে পারছেন না।

"বড়বোন হয়ে তুই এইটা কিভাবে করতে পারলি? সংসার ছাড়ার আগে একবারো ভাবলিনা তোর একট ছোটবোন আছে? তার বিয়ে দিতে হবে? পাত্র বাদ দিয়ে কুল পাচ্ছিলাম না আমি এতদিন নিতুর জন্য। তোর কাহিনীর পর এখন আর একটা প্রস্তাবও আসেনা। তুই এত স্বার্থপর কিভাবে হলি?"

এইতো, টুপ করে এক ফোঁটা পানি পড়লো গালে মায়ের, মাথা নিচু করে ফেললেন মা। অন্য চোখের পানি এখন মেঝেতে পড়বে। নিতু নিশ্বাস ফেললো সবার অলক্ষে, স্বাভাবিক গলায় বললো," আমি তো অন্যায় কিছু করিনি খালা। নিজে করিনি, তার করতে চেয়েছে আমি সেটাতেও সায় দেইনি।" মৌসুমি খালা নিজের কানকে বোধহয় বিশ্বাস করতে পারলেন না, তার মুখের ওপর কেউ কিছু বলতে পারে, কিছুক্ষণ থমকে থেকে তোতলাতে তোতলাতে বললেন," তুই অন্যায় কিছু করিস নি?"

নিতু শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললো,"না।"

খালা বড় বড় নিশ্বাস ফেললেন খানিকক্ষণ, নিতু ধৈর্য ধরে রইলো। সে জানে সে কি বলবে। সংসার করার জন্য পাঁচমাস অনেক কম সময় হতে পারে কিন্তু সারাজীবনের ডিসিশান নেওয়ার জন্য পাঁচমাস যথেষ্ট। খালা বহুকষ্টে চিৎকার না করে থমথমে গলায় বললেন," তোর বিয়ে হয়েছে পাঁচ মাস, পেটে তোর ছয়মাসের বাচ্চা। জারজ বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরিস আর তুই বলিস তুই অন্যায় করিস নি?"

মা আঁচল চাপা দিলেন মুখে, ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠার চাপা আওয়াজ আসছে তার আঁচল চাপা মুখ থেকে। মেইন দরজার নিচ থেকে ওপাশে ছায়া দেখা যাচ্ছে, পাশের ফ্লার্ট থেকে ওবায়দুল সাহেবের স্ত্রী এসে দাঁড়িয়েছেন বোধহয় দরজার ওপাশে। একা এসেছেন? মনে হয় না, শিরিনবানুকেও ডেকে নিয়ে আসার কথা।

নিতু নিশ্বাস ফেললো, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে সে। এখন একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই পা ব্যথা করতে থাকে তার। শান্ত গলায় বললো," আমার বাচ্চার বয়স ছয়মাস না, পাঁচ মাসই। ডাক্তার নিজে চেকাপ করে বলেছেন। বিয়ের রাতে জোর করার কথা সাজেদের মনে ছিল না? জারজ বাচ্চা বলতে পেরেছে,ধর্ষণের কথা বলেনি কেন আপনাকে সে?"

রাগে মৌসুমির নাক ফুলে ফুলে উঠছে, গালদুটো রক্তলাল, যেন একটু টোকা দিলেই রক্ত গড়িয়ে পড়বে গাল থেকে। হিংস্র গলায় বললেন," বিয়ের পর ধর্ষণ হয় কিভাবে? কই পড়ায় এইগুলা? তোর স্কুলে পড়ায়? নাকি সিনেমা দেখে শিখসোস এইসব বড়বড় কথা?"

নিতু হাসি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যে তার হাসি পাচ্ছে এটা ভেবেও অবাক লাগছে। সামনের মহিলাটাকে মনে হচ্ছে এক লালহাতি। না,না উন্মাদ হাতি। ইনার সাথে আত্মসম্মান নিয়ে কথা বলা মানে নিজের অপমান করা!

মৌসুমি উন্মাদের মতই বোনের দিকে তাকালেন," তোর মেয়ে কি বলে এগুলা শুনতেছিস? খালা আমি তার, আমার সামনে এইগুলা বলতে তার বাঁধতেসে না মুখে? এই তার শিক্ষা? বেহায়ার বেহায়া। বিয়ের আগে কার সাথে ফষ্টিনষ্টি করে আসছিস, পেট বাঁধায় ফেলছিস আর বর বাচ্চা নষ্ট করতে বললেই দোষ! খুব মানসম্মানে লেগে যায়?"

নিতুর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না, ক্লান্ত লাগছে অনেক। কখন এগুলো শেষ হবে আর সে তার বিছানাটাতে গিয়ে কুড়িমুড়ি হয়ে শুয়ে পড়বে, খুব লোভ হচ্ছে শুতে, খুব। নিতু মায়ের দিকে তাকালো, শুকনো কাঠির মত দেহটা মনে হচ্ছে এক্ষুনি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে নিচে। আঁচল চাপা সেই মুখ এখনো আঁচলে লুকানো। আচ্ছা, নিতু কি সত্যি ভুল করেছে অনেক? তার শ্বশুরবাড়িতেই থাকা উচিৎ ছিল? সাজেদের কথায় বাচ্চাটা চুপচাপ নষ্ট করে ফেলা উচিৎ ছিল? শুধুমাত্র বরের সন্দেহ হয়েছে বিধায়? কাকপক্ষীও যেন না জানে তার মধ্যে প্রাণ এসেছিলো একটা, শ্বশুর-শ্বাশুড়িও না, নিজের মা না, বোন না, কেউ না! বাচ্চাটাকে খুন করে এসে সোনামুখ করে সংসার করে যাওয়া উচিৎ ছিল তার? যেন কিচ্ছু হয়নি? তবে যে বাবা বলতেন, "নিজের আত্মসম্মান কখনো বিসর্জন দিও না।" তার কি হবে! মানুষটা বেঁচে থাকলে কি তিনিও মুখ লুকাতেন রুমালে বা পাঞ্জাবির কোণায়? নাহ্, মানুষট ঠিক রুখে দাঁড়াতেন, বুক সটান করে! বলতেন-.....। কি বলতেন? কি বলতেন বাবা? এমন কিছু নিশ্চয়ই যেটা শুনে সামনের এই উন্মাদ মহিলাটি কুঁকড়ে যেত নিমিষে। সাজেদের মুখেও লবণ পড়তো একদলা, জোঁকের মত কুঁচকে যেত সে নিজেও। কেন মরে গেল মানুষটা পনের বছর আগে? কেন?

"সাজেদের সাথে আমার কথা হয়েছে। এত কিছুর পরেও সে তোকে ঘরে নিতে চায়। হাজার রাকাত নামাজ পড় হারামজাদী। ছেলেটা চাচ্ছিলো পাপটা কাউকে না জানাতে, নিজের বাপমাকেও না। ভালোয় ভালোয় নষ্ট করতি, কাকপক্ষীও টের পেত না। নষ্টা বউকে নিয়ে ঘর করতে রাজি হইছে আর কত চাস তুই?"

মা কেঁপে উঠলেন একবার, মুখ তুললেন আঁচল থেকে, কাঁপা গলায় বার কয়েকের চেষ্টায় কোনমতে বললেন," নষ্টা বলো কেন আপা? কি করেছে নিতু?"

মৌসুমি চিৎকার করে বললেন,"তুইও মুখ খুলাস না রাবু। তোর মেয়ে যে নষ্টা বিয়ের রাতেই টের পেয়েছে সাজেদ। কোন ছেলের সাথে লাইন ছিল তোর মেয়ের এখন খোঁজ নিয়ে দেখ।"

নিতু মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, মায়ের কাঁধে হাত রাখলো তার। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো," মা, এত কষ্ট পেও না। তোমার মেয়ে কোন অন্যায় করেনি। তুমি তাকে কোনদিন কোন অন্যায় শেখাওনি, সে শেখেওনি। তুমি শক্ত হও, আমি আছি না?" মা শরীর কেঁপে উঠলো থরথর করে, পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি, নিতু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাকে। ছুটে এলো মিতুও! মৌসুমি বড় বড় শ্বাস ফেলছেন। নিতু শান্ত গলায় বললো,"আপনি বেরিয়ে যান। এক্ষণ এই মুহুর্তে বেরিয়ে যান। আপনার সাথে কথা বলার কোন ভক্তি হচ্ছে না আমার।"

মৌসুমি সত্যিকার অর্থেই মুখ হাঁ করে তাকালো নিতুর দিকে। মানুষটা তার অবাক হওয়ার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে আজকে। নিতুর কথা বুঝতেই তার বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগলো। কি বলবেন ভেবে পেলেন না কিছু। টলমল করে উঠে দাঁড়ালেন, কাঁপা হাতে ব্যাগটা তুললেন, তারপর চলে গেলেন দরজার ছিটকিনি খুলে। বের হওয়ার আগে কি যেন বলতে ঘাড় ঘুরিয়েছিলেন, গলা থেকে শব্দ বের হলোনা কোন। সারাজীবন দাপট করে চলা ছোটবোনের সংসার তাকে আজ বের হয়ে যেতে বলবে ব্যাপারটা হজম করাই বেশ কষ্টের! পুরোটা বুঝে উঠতে সময় তো লাগবেই, তারপর আবার নতুন উদ্যামে চিৎকার শুরু করবেন কাল পরশু! করবেনই! উন্মাদ মহিলার উন্মাদনা এত সহজে থামে না।

নিতু মিতু মিলে মাকে ধরে বসালো সোফাটায়। মা এখনো কাঁপছেন, তাকে ধরে রাখা যাচ্ছেনা। নিতু শান্ত গলায় বললো," মিতু দরজাটা বন্ধ করে আয়।" দরজার ওপাশের ফ্লাটের দরজাটা হাঁ করে খোলা, কেউ নেই! এতক্ষণে থাকার কথাও না। এপাশের দরজা খুলতে খুলতে ওপাশের লোকেদের ঘরের ভিতর ঢুকে যেতে বেশিক্ষণ লাগার কথা না। গল্প করার মত রগরগে কাহিনী পেয়ে গেছে তারা ইতমধ্যে! খালার সাথে সাথে তাদের এখানকার কৌতুহলও চলে গেছে, এখন গল্পগুলো রসিয়ে রসিয়ে অন্যদের করার পালা বাকি!

দরজা লাগিয়ে মিতু পানি এনেছে এক গ্লাস। মা সেটাও খেতে পারলেন না, কোনমতে এক ঢোক মুখে নিয়েই বমি করে দিলেন! নিতু মায়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে তখন থেকে, নিতুর দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলেন মা। নিতু হালকা গলায় বললো, " এত ভয় পেলে চলে মা? তুমিই না গতকাল মাত্র আমায় বলেছিলে লড়াই করতে পারতে হবে আমাকে? এখন তুমি নিজেই হেরে যাচ্ছো!"

মিতু নিজের চোখ মুছলো, ধরা গলায় বললো," এখন কি করবি আপা? ফিরে যাবি?" মিতুর দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে নিতু জিজ্ঞেস করলো,"তুই কি চাস? ফিরে যাই?" মিতু চুপ রইলো কিছুক্ষণ,তারপর স্পষ্ট গলায় বললো," না।"

মা সহজ হয়েছেন কিছুটা, তবু ফোঁপানো কণ্ঠে বললেন," কি করবি মা?"

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে নিতু বললো,"বাবা বেঁচে থাকলে যা বলতেন, তুমি যাতে সায় দিতে, এখন তাই করবো মা। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে ফোন দিয়েছিলাম মা গতকাল, উনি দেখা করতে বলেছেন। চাকরিটা আবার পাবো মনে হয়।"

মা কেঁদে উঠলেন আবার হুহু করে! কেঁদে উঠলো মিতুও! তিনজন তিনজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো! নিতুর মুখ কঠিন, অনেক কেঁদেছে সে ঐ সংসারে, অনেক! সব কান্না মনে হয় ঐখানেই ফুরিয়ে এসেছে, ছেড়ে এসেছে! এই বাড়িতে আর কান্না আসেনা।

কলিংবেলটা বাজলো আবার, হাসান এসেছে বোধহয়! কলেজ শেষ করে বাবার বন্ধু মোত্তালিব চাচার সাথে কথা বলে একটা এপোয়েন্টমেন্ট নিতে বলেছিলো নিতু তাকে, সেজন্য হাসানের দেরি হলো আজ। মোত্তালিব চাচা ভালো একজন লইয়ার! ডিভোর্সের ব্যাপারে ভালো উকিলের সন্ধান দিতে পারেন কিনা! মিতু উঠে গেল দরজা খুলতে! মা কাতর গলায় বললেন, " সাজেদ যদি ঝামেলা করে মা? খুব কঠিন হয়ে যাবে না? পারবি একা একা?" নিতু অল্প হেসে বললো,"যদি কি মা? ঝামেলা তো করবেই। কঠিন হবে জীবন। খুব কঠিন। তাই বলে জীবনে কঠিন কাজ কি করব না? শুধু সোজা কাজ করবো? এই শিক্ষা দিয়েছো আমাকে?"

মা চোখ মুছলেন নিজের, বৃথাই গেল সেটা। চোখ তার পানিতে ভরে গেল নিমিষে। আপন মনেই বললেন," জীবনে অবলম্বন লাগে মা, তোর বাবা চলে যাওয়ার পর বুঝেছি, অবলম্বন ছাড়া বাঁচা যায় না। মিতুর বিয়ে হয়ে যাবে, হাসান বড় হয়ে কোথায় চলে যাবে! আমি আজ আছি, কাল নেই। তুই কি করবি?"

নিতু নিজের ওড়না দিয়ে মায়ের চোখ মুছে দিলো, সহজ গলায় বললো,"বেঁচে থাকার অবলম্বন সবার আগে নিজে হতে হয় মা। নয়তো তুমি দেখো আর কারোরই নিশ্চয়তা নেই।"

মা নিতুর হাত ধরে কাতর গলায় বললেন," তাও কাউকে লাগে মা।" নিতু কিছু বললো না। জীবনের অবলম্বন কি সবসময় স্বামীকেই হতে হয়, আর কেউ হয় না?

ঠিক তখন নিতুর ভেতরের প্রাণটা নড়ে উঠলো! এত শোরগোলের মাঝেও ঘুমাচ্ছিলো এতক্ষণ বোধহয়, ঠিক সময় জেগে উঠেছে! হাতপা ছুঁড়ে জানান দিচ্ছে নিজেকে। নিতু হাত রাখলো সেই ছোট্ট প্রাণটার ওপর! এই এই আবার নড়লো !! তার ভেতরের এই নতুন অস্তিত্বটা ভারি চঞ্চল! হাত দিয়ে তাকে একটু ছুঁয়ে দিয়ে নিতু খুব আস্তে করে বললো," হুম, হুম, ঠিকাছে তো বাবা বুঝেছি, তুইই আমার অবলম্বন। এত উত্তেজিত হতে হবে না।" বাবুটা বুঝলো না, নড়ে উঠলো আবার! সে আরো ভালো করে বোঝাতে চায় তার মাকে সেটা, আরো ভালো করে !!!


1 comment

Recent Posts

See All

1 Yorum


এটা মানা যায় না, এইধরনের লেখাগুলো আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের দৃষ্টিতে নেওয়া উচিৎ

Beğen
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page