ইসলামিক রোজা নিয়ে ইসলামিস্টদের প্রচার করা বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডার জবাব
- Just Another Bangladeshi
- Dec 28, 2018
- 5 min read
লিখেছেন: মাহনাজ হোসেইন ফারিবা

(এই লেখাটির লেখিকা নাস্তিক নন, নাস্তিকতা প্রচার করার উদ্দেশ্যে তিনি লেখাটি লেখেন নি। লেখাটি তার অনুমতি সাপেক্ষে তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
ফেসবুকে প্রতি বছর ‘অটোফ্যাগি মানেই রোযা’, এ বিষয় নিয়ে যে অপবিজ্ঞান ও ভ্রান্তবিজ্ঞান (সিউডোসায়েন্স) সবাই ছড়িয়ে থাকে, সে ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
☞ অটোফ্যাগি হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যা শুধুমাত্র শরীরে তখনই হয় যখন আপনি মেটাবলিক স্ট্রেসে আছেন, অথবা নিউট্রিয়েন্ট ডেপ্রাইভড স্টেটে আছেন, অর্থাৎ শরীরে পুষ্টি উপাদান কম এমন অবস্থায়। এই প্রক্রিয়ায়, যেসব কোষীয় অঙ্গানু পুরনো হয়ে গেছে এবং প্রয়োজন নেই তা কোষ ভেঙ্গে ফেলে অটোফ্যাগোসোম তৈরীর মাধ্যমে। অর্থাৎ ছোট ছোট কম্পার্ট্মেন্টে ওই অঙ্গানুগুলোকে আবদ্ধ করে এরপর ভেঙ্গে ফেলে এমিনো এসিডে। এটি একধরনের কোষীয় বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়া, ও প্রয়োজনীয় পদার্থগুলো রিসাইকেল করবার প্রক্রিয়া।
☞ না খেলে অবশ্যই শরীরে মেটাবলিক স্ট্রেস তৈরী হয়, নিউট্রিয়েন্ট ডেপ্রাইভেশন হয়। তখন শরীরে ইনসুলিন কমে যায়, গ্লুকাগন বেড়ে যায়। এই গ্লুকাগন হরমোন সিগন্যাল দেয় শরীরে অন্যান্য গ্রোথ হরমোন বাড়াতে। নতুন করে বিভিন্ন প্রোটিন তৈরী হয়। এছাড়া অনেকগুলো জিন সুইচ অন হয়, যার মধ্যে mTor, TOR ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এমনকি শরীরে বেশী প্রোটিন থাকলেও অটোফ্যাগি প্রসেস বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে যেকোনো ক্যান্সার রোগী না খেয়ে থাকলে আসলে লাভ হবে কিনা তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে কারণ তার শরীরে এমনিতেই বেশী প্রোটিন।
☞ ক্যালোরিক রেস্ট্রিকশন হল অটোফ্যাগির ফিজিওলজিক্যাল ইন্ডিউসার। রাপা হল ফার্মাকোলজিক্যাল ইনডিউসার (ঔষধ)। এছাড়া p53 জিন যদি বন্ধ করে দেয়া যায়, তাহলেও অটোফ্যাগি হয়।
** ইন্ডিউসার মানে হল যা কোনো জিনিসকে শুরু হতে উস্কে দেয়।
এছাড়া atg, Sirt-1 ইত্যাদি বহু জিন আছে যা অটোফ্যাগি স্পেসিফিক। (এখন পর্যন্ত অটোফ্যাগির সাথে জড়িত ৩২টি জিন আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তিন ধরনের অটোফ্যাগি প্রক্রিয়াঃ মাইক্রো, ম্যাক্রো এবং চ্যাপেরন মেডিয়েটেড আবিষ্কৃত হয়েছে) অটোফ্যাগি, অর্থাৎ ক্যালোরিক রেস্ট্রিকশন বুড়িয়ে যাবার প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়, এটি বিভিন্ন আর্টিকেলে লেখা আছে।
কিন্তু এ বিষয়ে উল্লেখ্য, ক্যালোরিক রেস্ট্রিকশন এবং ফাস্টিং/অর্থাৎ রোযা রাখা এগুলো কিন্তু এক জিনিস নয়, তা শিক্ষিত মানুষ মাত্রই জানে।
☞ শরীরে এমিনো এসিডের তিন ধরনের বিপাক প্রক্রিয়া আছে। কিছু এমিনো এসিড লিভারে চলে যায় ও গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদন করে। কিছু এমিনো এসিড ট্রাই কার্বক্সিলিক এসিড সাইকেল (TCA cycle) এ ঢুকে ও গ্লুকোজ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। আর কিছু এমিনো এসিড নতুন প্রোটিন তৈরীতে ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ রিসাইকেল হয়।
এখন যদি শরীরে এর বেশী এমিনো এসিড থাকে, তাহলে শরীর তা বর্জ্য আকারেই বের করে দিবে।
☞ এ বিষয়ে আরও উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ইয়োশিনোরি উশুমি যে অটোফ্যাগি বিষয়ক গবেষণার জন্য নোবেল পেয়েছেন, তার বিষয়বস্তু হল অটোফ্যাগি-সেলুলার রিসাইকেলিং প্রসেস অর্থাৎ মেকানিজমটির বিষয়ে গবেষণা করে। তিনি অটোফ্যাগি ও রোযা অথবা অটোফ্যাগি ও পানি না খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ের উপরে গবেষণা করে নোবেল পাননি, এ বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। আর এ গবেষণার মূল ভিত্তি হল স্ট্রেস হলেই অটোফ্যাগি হয়, এই স্ট্রেস শরীরে হয় হয় নিউট্রিয়েন্ট (পুষ্টি উপাদান) কম হলে, ইনফেকশন হলে, হাইপোক্সিয়া হলে (অর্থাৎ শরীরে অক্সিজেন কম হলে) এবং শরীরে গ্রোথ ফ্যাক্টর কম থাকলে। আমি সূত্র হিসেবে ন্যাচার জার্নালের রিভিউ দিয়ে দিচ্ছি। এটি অনেকেই দেখতে পারবেনা কারণ ন্যাচার হল পৃথিবির সর্বশ্রেষ্ঠ জার্নাল আর এখানে সবার এক্সেস নাই। আমার পিডিএফ ডাউনলোড করা আছে কেউ এক্সেস চাইলে আমি ইমেইল করে দিতে পারি।
☞ আরেকটি অপবিজ্ঞান যা ছড়ানো হচ্ছে ফেসবুকে, তা হল ক্যান্সারকে নাকি অটোফ্যাগি প্রতিহত করে!
ক্যান্সার অথবা আলঝেইমার রোগের মূল ভিত্তি হল অধিক গ্রোথ। আলঝেইমারে প্রোটিন একিউমুলেশন হয়। অর্থাৎ অনেক প্রোটিন জমা হয়। এখন গবেষণার মূল বিষয়বস্তু হল টার্গেটেড অটোফ্যাগি কীভাবে করা যায়, অর্থাৎ শরীরের একটা জায়গায় ক্যান্সার অথবা আলঝেইমার হচ্ছে ব্রেইনে, তাহলে ওই জায়গার কোষগুলোকে কীভাবে সিগন্যাল দিয়ে সেখানে অটোফ্যাগির মাধ্যমে সেই প্রোটিনগুলোকে ধ্বংস করা যায়। সেক্ষেত্রে তৈরী হওয়া অতিরিক্ত এমিনো এসিড রিসাইকেল হবে, না শরীর বের করে দিবে তা শরীর সিদ্ধান্ত নিবে। কেউ যদি রোযা/উপবাস করে ভাবেন যে আমি ক্যান্সার থামিয়ে ফেললাম, তাহলে খুবই ভুল কথা, কারণ এসব রোগের চিকিৎসার জন্য সারা শরীরে অটোফ্যাগি না বরং টার্গেটেড অটোফ্যাগি প্রয়োজন।
এ বিষয়ে আরও উল্লেখ্য, ন্যাচারের রিভিউটিতে দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রি-ম্যালিগন্যান্ট কোষ (অর্থাৎ যারা পুরো ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যাবে যাবে ভাব) এমন কোষগুলো অনেকসময় অটোফ্যাগি ব্যবহার করে জিনোটক্সিক যে স্ট্রেস থাকে ক্যান্সারে, তাকে বাইপাস করে একেবারে ক্যান্সার ছড়াতে সাহায্য করে। অর্থাৎ অটোফ্যাগির নেগেটিভ ব্যবহারও শরীরে আছে। বিজ্ঞানের ভাষায় বলে অটোফ্যাগির যেমন এন্টি-টিউমোরাল ভূমিকাও আছে, প্রোটিউমোরাল ভূমিকাও আছে। অর্থাৎ কখনো কখনো ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, কখনো ক্যান্সার বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় ক্যান্সার কোষগুলো অটোফ্যাগির মাধ্যমে নতুন জীবন লাভ করে ও শরীরের আরও ক্ষতি করে। কিন্তু এ বিষয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
আলঝেইমার, পার্কিনসন, হান্টিংটন, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে অটোফ্যাগি দিয়ে আসলেই চিকিৎসা (টার্গেটেড থেরাপি) সম্ভব কিনা বা এর ভূমিকা কী এ বিষয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তবে নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ, অর্থাৎ আলঝেইমার, হান্টিংটন, পার্কিনসনে এখনও অটোফ্যাগির ক্ষতিকারক প্রভাব পাওয়া যায়নি। [সূত্র ২ দ্রষ্টব্য]
☞ অনেকসময় ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন অথবা অটোইমিউন রোগগুলোর জন্য অটোফ্যাগির ভালো ভূমিকার কথা ফেসবুকে অনেকে ছড়িয়ে থাকে। এর ভেতরে অনেক ভুল আছে।
এ কথা সত্য, যে শরীরে ইনফেকশন হলে অটোফ্যাগি প্রক্রিয়ায় শরীর অনেক সময় তা তাড়িয়ে থাকে। কিন্তু আমরা জানি ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস ক্রমাগত মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেদের জিনোমে পরিবর্তন আনে। এভাবে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়া এই অটোফ্যাগি প্রক্রিয়া নকল অথবা বাইপাসের মেকানিজম অর্জন করে ফেলে। তখন কিন্তু অটোফ্যাগি কোনো সুস্থতার গ্যারান্টি দিতে পারেনা, বরং তখন ট্রেডিশনাল ট্রিটমেন্টেই যেতে হবে। [সূত্র ২ দ্রষ্টব্য]
☞ ক্রমাগত না খেয়ে থাকা আসলেই কি সবসময় অটোফ্যাগি চালাতে থাকে? না, বরং এতে শরীরেরই ক্ষতি হয় বেশী। ফাস্টিং-ফিডিং সাইকেলের একটি ভারসাম্য থাকতে হবে। অটোফ্যাগি পরিমাপক বিষয়ক যে মাউস মডেলগুলোর উল্লেখ আছে, সেখানে কিন্তু পানি খাওয়ার কথা বলা আছে। নিউট্রিয়েন্ট রেস্ট্রিকশন এবং ওয়াটার রেস্ট্রিকশন কিন্তু এক কথা নয়। সূত্র নং ৩ এ স্পষ্ট লেখা আছে,
“The most potent known physiological inducer of autophagy is starvation. It is the most rapid and easiest method for stimulating the induction of the autophagy machinery in mice. Mizushima and colleagues measured an autophagy response in mice deprived of food for 24 or 48 h. During starvation experiments, mice should have water ad libitum and their temperature and blood pressure checked periodically. Although autophagy is regulated differently among organs, autophagy is still induced in most organs in response to nutrient starvation. However, the appropriate time of starvation should be determined empirically because autophagic responses to various stimuli or in disease states can differ between organs.”
অর্থাৎ পানি খেতে হবে। এ বিষয়ে আরও উল্লেখ্য, মানুষের মধ্যে এই অটোফ্যাগি পরিমাপক গবেষণা এখনও করা হয়নি সেভাবে। এখন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে (টিস্যু অথবা ব্লাড স্যাম্পল থেকে) অটোফ্যাগি পরিমাপের সঠিক মেথড/প্রটোকল নেই। [সূত্র ৫ দ্রষ্টব্য] কাজেই কেউ এখনও বলতে পারেনা মানুষের ভেতরে কী করলে কী হবে।
☞ ভালো অটোফ্যাগি আছে, মন্দ অটোফ্যাগিও আছে। [সূত্র ৬ দ্রষ্টব্য] এটি নির্ভর করে হোস্টের শারীরিক অবস্থা কেমন তার উপর।
শেষ কথাঃ শরীরের বর্জ্য পদার্থ পানির সাথেই কিডনী ছেঁকে বের করে দেয়। পানি সারাদিন না খেয়ে থাকাটা অটোফ্যাগি প্রসেস না। অটোফ্যাগির মাধ্যমে শরীরের যেটুকু এমিনো এসিড লাগবে তা শরীর রেখে দিবে, যা লাগবেনা তা বের করে দিবে। আর ক্যান্সার ও অন্যান্য অসুখের মূল বিষয়টিই হল অধিক গ্রোথ। জাংক প্রোটিন তো বের করে দিতেই হবে সেক্ষেত্রে। ড্রাই ফাস্টিং অর্থাৎ পানি ছাড়া থাকা ১-৩ দিনের বেশী অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কেউ কেউ ধারণা করে থাকে, শরীরের ভেতরের রোগজীবাণু পানি পায়না দেখে মরে যায়, তাই এ ধরনের ড্রাই ফাস্টিং অত্যন্ত উপকারী। বাস্তবতা হল, শরীর নিজের পানি নিজে প্রস্তুত করতে থাকে এ সময়, বিভিন্ন ফ্যাট বার্নিং বিক্রিয়ার মাধ্যমে, কাজেই রোগজীবাণু পানি না পাবার বিষয়টি সত্য নয়। সারাদিনে শরীর বিভিন্ন মেটাবলিক রিয়েকশনের মাধ্যমে প্রায় ১ লিটার পর্যন্ত পানি প্রস্তুত করতে পারে। কিন্তু প্রতিদিন ড্রাই ফাস্টিং এর ফলে ডিহাইড্রেশন হয়ে যায়। এবিষয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে। এখন পর্যন্ত বেশীরভাগ পেপারই শুধুমাত্র ক্যালরিক রেস্ট্রিকশনে সীমাবদ্ধ, ওয়াটার রেস্ট্রিকশনের বিষয়টি এড্রেস করা হয়নি। নিউট্রিয়েন্ট ডেপ্রাইভেশন-ক্যালোরিক রেস্ট্রিকশন এর সাথে ওয়াটার রেস্ট্রিকটেড ফাস্টিং (অর্থাৎ রোযা) কে মিলাবেননা দয়া করে। বিজ্ঞান বিজ্ঞানের জায়গায় সুন্দর, ধর্ম ধর্মের জায়গায়। দুইয়ে মিলালে সিউডোসায়েন্স হয়ে যায় যা সবার জন্যই খারাপ। আর সবচেয়ে বড় কথা, রিসার্চ পেপার ও জার্নাল দেখে কথা বলা উচিত। কোনো ব্লগ অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার কথায় কারোরই বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত না।
ধর্মে মূলকথা হল বিশ্বাস। চলুন আমরা স্রষ্টাকে খুশি করতে রোযা করি যা একটি ফরয ইবাদত। কোনো ধরনের ভ্রান্ত বিজ্ঞানে অথবা ফেসবুকের ভ্রান্ত জ্ঞানে উদবুদ্ধ হয়ে নয়। ধন্যবাদ।
সূত্র সমূহঃ
(এই লেখাটির লেখিকা নাস্তিক নন, নাস্তিকতা প্রচার করার উদ্দেশ্যে তিনি লেখাটি লেখেন নি। লেখাটি তার অনুমতি সাপেক্ষে তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
সুন্দর লিখছেন….
আপনার সবগুলো পোস্টই দুর্দান্ত
লেখাগুলো অসাধারণ হয়েছে…
লেখাগুলো অসাধারণ হয়েছে…
খুবই ভালো লিখেছেন….