কাউকে মিস করা

রাত ১২টা হবে। আমি শুয়ে শুয়ে মাসুদ রানা পড়ছি। টেবিলের উপর ল্যাম্প জ্বালানো। হঠাৎ করেই পাশের বাসা থেকে সেই আদিম শব্দটা শুরু হল। ক্যাঁচক্যাঁচ করে তুমুল শব্দে খাট নড়ছে। পাশের বাসার লোকটা মনে হয় ঢাকা থেকে এসেছে। আমি ভয়ে ভয়ে আমার রুমমেট জলিল ভাইয়ের দিকে তাকালাম। হ্যা উনি জেগে আছে। মশারির ভেতরে সিগারেটের ফুলকি দেখা যাচ্ছে। “দেখসো কারবার?’’ জলিল ভাই বলল আমাকে। “জি ভাই।” “ঐ হালা হাড্ডি মন্ত্রী কী যে খায় কে জানে। উড়ায় ফেলতেসে পুরা।” আমি আস্তে করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। নইলে জলিল ভাইয়ের এই অশ্লীল বর্ণনা শেষ হবে না। গ্রাম থেকে এসে এই মেসে উঠেছি আজ পাঁচ মাস। সরকারী ব্যাংকের চাকরির জন্যে কোচিং করতে এসেছি চট্টগ্রাম শহরে। মেসের বাসাটা টিনের ঘর। পাশাপাশি লাগানো বাসা। এজন্যেই এই শীতের রাতের নিস্তব্ধতায় পাশের ঘরে কি হয় না হয় স্পষ্ট শোনা যায়। পাশের বাসার ভদ্রলোক ঢাকায় চাকরি করে। ১০-১৫ দিন পরপর আসে। আমার রুমমেট জলিল ভাই প্রথম দিনেই নিজের জাত চেনায় দেয়। আমাকে বলে, “শোনো আমার সাথে রুম শেয়ার করতেছো সমস্যা নাই। কয়েকটা জিনিস মাইন্যা চলবা। পড়লেখা যা করবা তা টেবিল ল্যাম্প জ্বালায় করবা। আমার ঘুমের সমস্যা আছে। লাইট জ্বালায় রাখলে ঘুম হয় না। টয়লেট পরিষ্কার রাখবা। আর টয়লেটে গেলেই কল ছাইড়া দিবা। টয়লেটে কি করতেছো না করতেছো শব্দ কইরা মাইনষেরে জানাবার কিছু নাই।” আমি মাত্রই সেদিন এসেছি। এমনিতেই মা আর ছোট ভাইয়ের জন্যে পেট পুড়তেছিল*। উনার কথা শুনে মন আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে মাঝে মাঝেই পাশের বাসার ঢাকার এই লোক আসলে সেই রাতে আর ঘুমই হয় না। খাটের ক্যাঁচক্যাঁচ আর জলিল ভাইয়ের ধারাবর্ণনা। এই সব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন কোচিং এ যাওয়ার জন্যে বের হচ্ছি, পিছনে জালাল ভাইও আছে। উনি অফিসে যাচ্ছে। বের হতেই দেখি পাশের বাসার ভদ্রলোক এই শীতের মধ্যেই স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে উঠানে বসে নখ কাটছে। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ভালো?’’ আমি হাসি ফিরিয়ে দিলাম। জলিল ভাই উনার সামনে এসে বলল, “ভাই আপনি খাওয়াদাওয়া কী করেন একটু মেন্যুটা দিয়েন তো একদিন। এই স্বাস্থ্য নিইয়া সারারাত কারগিল সীমান্তের যে যুদ্ধটা চালান।” দেখলাম লোকটি মাথা নিচু করে নখ কাটতে লাগলো। আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলাম। আমাদের কোচিং এর স্যার মিঠু ভাইকে আমার খুব ভাল লাগে। কোন রাখডাক না রেখে খুব চমৎকার করে কথা বলে। প্রথমদিন কোচিং এ এসে আমার মাথায় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি একেবারে ইস্ত্রি করা ফুলহাতা শার্ট পরে এসেছিলাম। আর বাকি ছেলেগুলো টিশার্ট, জিন্স আর স্যান্ডেল পরে কি চমৎকারভাবে ক্লাস করতে চলে আসে। আমার সমস্যা ইংলিশে। উচ্চারণ খারাপ, বুঝিও কম। অংকে কোন সমস্যা নেই। ক্লাসে আমি একপাশে চুপচাপ বসে থাকি। কারো সাথে কোন কথাই বলি না। সেদিন ক্লাসে দেরি করে যাওয়াতে দেখি সব সিট বুকড। সামনে শুধু একটা সিট খালি আছে। একটা মেয়ে বসে। আমি চিনি মেয়েটাকে, ডাক নাম বিনতে। এত সুন্দর করে কথা বলে আমি প্রায় হাঁ করে পেছন থেকে তাকিয়ে থাকি। আমাকে দেখে মিঠু ভাই বলল, “দাঁড়ায় আছো কি মনে করে? এখানে বসে যাও।” আমি প্রথমে বুঝিনি মিঠু ভাই কি বলছে। বিনতের পাশে বসতে বলছে? ঠাট্টা করছে নাকি? দেখি বিনতে তার ব্যাগ সরিয়ে এক পাশে সরে আমাকে জায়গা করে দিচ্ছে। আমি কোনমতে হেঁটে গিয়ে বসে পড়লাম। ইংলিশ ক্লাসে কি হল কিছু কানে ঢুকল না। আমি কোনভাবে এক পাশে সরে বসে আছি। বিনতের ব্যাগের সাথেও যেন কোন রকম স্পর্শ না লাগে আমার প্রাণান্তকর চেষ্টা। শেষে ৩০ নম্বরের একটা ম্যাথের এমসিকিউ টেস্ট হল। আমি বুঁদ হয়ে ম্যাথ শেষ করলাম। তখনো পাঁচটা বাকি কিভাবে যেন টাইম শেষ হয়ে গেল। “কেমন হল?’’ বিনতে আমাকে জিজ্ঞাসা করল। “অ্যাঁ?’’ “টেস্ট কেমন দিলে?’’ বিনতে আবার জিজ্ঞাসা করল। "ভালোই তো।" এই বলে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।ক্লাসে থাকলে আবার বিনতের সাথে কথা বলতে হবে এই ভয়ে। ১৫-২০ মিনিট পরেই মিঠু ভাই অংকের এমসিকিউ শিট চেক করে নিয়ে এলো। এসেই বলল, “সব গাধা আর ছাগলের পাল নিয়ে পড়সি। এতদিন কী পড়াইসি তোমাদের? ব্যাংকের দারোয়ানের চাকরিও তো পাবা না কেউ।” এরপর উনি নাম ডেকে ডেকে শিট দিচ্ছিল আর নাম্বারও বলছিল। মোটামুটি সবাইকে ধুয়েই দিচ্ছিল। আদনান নামে একজন আছে একটু মোটাসোটা যে নাকি আজ অনেকদিন ধরেই ভাইয়ার এখানে আসতেছে। “আদনান কই? ৮ পাইছোস। আরে কষ্ট করে উঠে আসতে হবে না। তোরে আমি সম্মান করি। এক বছর ধরে পড়তেছোস। আমিই শিট পৌঁছে দিচ্ছি।” আদনান দেখলাম ৮ পেয়েও মুচকি মুচকি হাসতেছে। “বিনতে ১৪। রাফ করতে করতে তো শিট ভর্তি ফেলসো তুমি।” “আতিকুর রহমান কে?’’ “আমি দাঁড়ালাম।” “২০ পাইছো, হায়েস্ট। ভেরি গুড।” সবাই দেখলাম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় আমার মনে হচ্ছিল বেঞ্চের নিচে ঢুকে পড়ি। ক্লাস শেষে বিনতে বলল, “আরে তুমি দেখি ম্যাথে সেই।” “সেই মানে। ছুপা রুস্তম। ভাব দেখাইয়া চুপচাপ বইয়া থাকে। এই তুমি কাল থেকে আমাদের গ্রুপ স্টাডিতে বসবা।” আদনান এসে বলল। আমি কোনমতে একটু হাসলাম। এত সব জানলে দাঁত মেজে আসতাম। আজ তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে দাঁতও মাজা হয় নাই। আমি সেদিন যেন উড়ে উড়ে বাসায় গেলাম। মনে হচ্ছিল রাজ্য জয় করে ফেলছি। ব্যাংকের চাকরি আমার হয়েই যাবে কোন একদিন। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ের পাশে বসা, হায়েস্ট পাওয়া কাল থেকে আবার ওদের সাথেই গ্রুপ স্টাডি।
মেসে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা গল্পের বই নিয়ে উঠানে বসলাম। দেখি পাশের বাসার মহিলাটা এসে বলল, “ছুডু ভাই ভালা আছেন?’’ “জি ভালো, আপনি?’’ আমি যখন প্রথম এই মেসে আসি, একদিন এই মহিলার বাচ্চার রাতে কিছু ওষুধ লাগতেছিল। আমি গিয়ে নিয়ে আসছিলাম। সেই থেকে উনি আমাকে খুব দেখতে পারে। মহিলা এদিক ওদিক তাকায় বলল, “ছুডু ভাই একটা কথা কই, কাউরে কইয়েন না। আপনাগো জলিল ভাই আমার সাহেবরে উল্টাপাল্টা কথা কয়। ওইদিন বাজারে সবার সামনে কি কইছে। আপনারা জানেন না, আমার সাহেবের কিন্তু রগচটা। ওর আন্ডারে অনেক পোলাপাইনও আছে। জলিল ভাইরে আপনে একটু আপনার মত করে সাবধান কইরা দিয়েন।” সেদিন বিকালে জলিল ভাই অফিস থেকে ফিরলেই আমি বললাম, “ভাই একটা কথা ছিল।” “কি হইসে আবার?’’ জলিল ভাই লুঙ্গি পরতে পরতে বলল। “এই যে পাশের বাসার ভাইরে যে আপনি…… ইয়ে মানে….. মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কিছু বলেন। না বললেই তো ভাল। উনি মাইন্ড করতে পারে।” “আরে কিয়ের বালের মাইন্ড করবো। তুমিও দেখি উকালাতি করতেসো। ক্যান পাশের ভাবী কিছু খাওয়াইছে নাকি তোমাকে? যাও আমার জন্যে পাঁচটা সিগারেট নিইয়া আসো।” সেদিন সন্ধ্যার পর পড়তে বসছি। হঠাৎ করেই শুনি বাইরে খুব হইচই। বের হয়ে দেখি জলিল ভাইকে সবাই ধরাধরি করে নিয়ে আসতেছে। মাথায় ব্যান্ডেজ। ডান চোখ খুব বিশ্রীভাবে ফুলে আছে। পাশের বাসার মহিলাকে দেখি মুখে কাপড় চাপা দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পাতলা দুবলা ওই লোকের কি রকম জানাশোনা আছে বোঝা গেল। যদিও জলিল ভাই বুঝতেই পারলো না কারা এই কাজ করলো। উনি পরদিনেই বাড়িতে চলে গেলো। কোচিং এ গ্রুপ স্টাডি শুরু হল। বিনতে আমার মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিলো। রাতে ম্যাথ করার সময় আটকে গেলে আমাকে ফোন করবে মাঝে মধ্যে। বিনতেকে নিয়ে একটা স্বপ্ন ভেবে আসতে আসতে ওইদিন এলাকার মোড়ে গর্তে পড়ে পা ছিলে ফেললাম।
কিছুদিন পর একদিন বাতিঘরে গেলাম বই পড়তে। এই শহরে এটাই আমার খুব প্রিয় জায়গা। বসে বসে বই পড়া আর এক কাপ কফি খাওয়া। বাতিঘর থেকে বের হতেই দেখি বিনতে সাথে লম্বা করে একটা ছেলে। আমাকে দেখেই বিনতে বলল, “আরে আমাদের অংকের সাবমেরিন।” পাশের ছেলেটাকে সে পরিচয় করিয়ে দিল তার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে। বয়ফ্রেন্ড মানে কি প্রেমিক? এটা নিয়ে ভেবে আসতে আসতে ওইদিন এলাকার মোড়ের সেই গর্তে পড়ে আবার পা ছিলে ফেললাম। সেদিন রাতে আমার ঘুমই হলো না। বিনতের প্রেমিক থাকবে কেন? আমি ব্যস্ততা দেখিয়ে আর গ্রুপ স্টাডিতেই গেলাম না।
এক বছর পরঃ একটা সরকারী ব্যাংকের ভাইভা বোর্ড। আমার দ্বিতীয় ভাইভা। অনেক প্রশ্ন শেষে একজন জিজ্ঞাসা করল, “আপনি তো আগে কখনো চাকরি করেননি, না? ধরেন এই চাকরিটা আপনার হয়ে গেল। সরকারী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। ভালই বেতন, প্রথম মাসের টাকা পেয়ে কী করবেন?”” “আমার আম্মাকে দিবো।” “কেন? আপনার আব্বাকে নয় কেন?”” “আমার আব্বাও বেতন পেয়ে আমার আম্মার হাতে দেয়।“ আমি মাথা নিচু করে বলে ফেললাম। বোর্ডের সবাই হেসে ফেলল। ঢাকা থেকে ট্রেনে করে বাড়িতে যাওয়ার সময় কেন জানি মনে হল এই চাকরিটা আমার হয়ে যেতে পারে। আমাদের অনেক দিনের বিবর্ণ সংসারে হয়তো একটু সুখের রং লাগবে। ট্রেন একটা স্টেশনে থামল। জানালা দিয়ে দেখলাম এক কানা ফকির একতারা বাজিয়ে একটা গান গাচ্ছে সাথে একটা ছোট মেয়ে। ‘ও মনা, তুই কি হবি অমবস্যায় পূর্ণিমারই চাঁদ, তুই কি দিবি মনের গাঙ্গে শক্ত একখান বাঁধ? তুই কি যাবি আমায় নিয়া সেই সে অচিনপুর? ও মনা, তুই কি জানিস তুই বললে, আমি যামু বহুদুর...... ও মনা, যামু বহুদুর............।’ কি করুণ সেই সুর। আমার মন কেন জানি হু হু করে উঠলো। কোথায় সে অচিনপুর? কে জানে কতদূরে.............. ________________ *পেট পোড়া= কাউকে মিস করা। *শেষের গানের লাইনগুলি "কল্পতরু টুনটুনি" এর টাইমলাইন থেকে নেওয়া।
Commentaires