top of page
Writer's pictureJust Another Bangladeshi

কঙ্কাল


জন্মের ২/৩ বছরের সময়ই নাকি আমার দাদা দাদী বুঝতে পারেন তাদের প্রথম সন্তানটি জন্মগত পাগল । তার চলা ফেরা, হাটা চলা, কথাবার্তা নাকি অন্য সুস্থ ছেলেদের সাথে মিলতোনা।সব সময় এক অস্থিরতা তার মধ্যে দেখা যেতো। পুকুরে নামলে সারাদিন তাকে পুকুর থেকে তোলা যেতোনা , খাওয়ার সময় গাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে একা একা বিড় বিড় করতো । বাড়িতে মেহমান এলে লাঠি নিয়ে তার পিছু পিছু দৌড়ে বাড়ির ত্রিসিমানা পার করে দিতো ।

একবার সারাদিন পুকুর থেকে কেউ উঠাতে পারেনা , পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে সবাই তামাশা দেখে । দাদী কেঁদে হয়রান হয়ে নিজেই ঝাপ দিলেন পাগল ছেলেকে তুলতে , প্রায় পাড়ে তুলে এনেছেন এমন সময় বাবা নাকি দাদীকে ছুড়ে মাঝ পুকুরে ফেলে ছুটে পালায় । তিন দিন পর বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায় বাজারের বট গাছের মগডালে । ডালে পা দুলিয়ে গাছের শুকনো ডাল ভেঙে হালিম চাচার মাথায় ছুড়ে বলেন - ভুক লাগছে, খাওন দে । কারো একজনের উপর থেকে ডাক শুনে বাজারের দোকানদার হালিম চাচা বাবাকে টেনে হিচরে নামিয়ে আনেন । হালিম চাচার উপর ক্ষেপে বাবা নাকি কামড়ে চাচার ঘাড়ের মাংশ তুলে নিয়েছিলেন ।

বাবার পিঠেপিঠি ছোট দুই ফুপু , রুপে গুনে অতুলনীয়া । আমার ফুপুদের মতো সুন্দরী নাকি আমাদের গ্রামে কম ছিলো , অথচ ওই ফুপুদের বিয়ে দিতেও দাদার বেশ বেগ পেতে হয়েছে । কন্যার ভাই পাগল , পাগলের বোন বিয়ে করতে কেউ সাহস পেতোনা । বাবার ভয়ে কেউ বাড়ির ত্রিসিমানায় আসার সাহস পেতোনা ।

বোন দুজনের বিয়ের সুবিধার জন্য মায়ের খালারা তাদের বাড়ি নিয়ে বিয়ে দিয়ে পাত্রস্থ করেছেন । তাদের জামাইরাও বাবার দৌড়ানোর হাত থেকে নিস্তার না পেয়ে শ্বশুর বাড়ি আসা ছেড়ে দিয়েছেন ।

দাদা দাদী তাদের সাধ্যমতো কবিরাজ দিয়ে ঝাড়ফুক করিয়ে ডজন ডজন তাবিজের মাদুলী গলায় ঝুলিয়ে দিতেন । তাদের ছেলে সেই মাদুলি ছিড়ে তাবিজ বের করে মাঝ পুকুরে ছুড়ে ফেলে বলতেন - ওই যাহ্ ।

এমনি করে ছেলে বড় হলো , এখন বছরের গরমের ৬ মাস পাগল আর শীতের ৬ মাস ভালো থাকেন । শীতের ৬ মাস দাদা দাদীর শান্তির মাস , গরমের সময় তাদের দুশ্চিন্তা আর অশান্তি ! বছর গেলে বয়স বাড়ে , বয়স বেড়ে বেড়ে বাবা গায়ে গতরে যুবক । গতরের সাথে মনের বড় অমিল , গতর বাড়লেও বুদ্ধি বাড়েনা অথবা পাগলের আবার বুদ্ধি কি ? বড় ছেলের সাথে সাথে ছোট ছেলেরাও তাগড়া জোয়ান মরদ , ওদেরও সংসারী হওয়ার বয়স হয়েছে, দাদা দাদীর বয়স হয়েছে, ছেলেদের বিয়ে দিয়ে সংসারি করে শান্তিতে মরতে চান । অন্যদের নিয়ে সমস্যা নেই , যতো সমস্যা বড় ছেলেকে নিয়ে ।

এক মাঘের হাড় কাপানো কনকনে শীতে ১০ গ্রাম পেরিয়ে সব গোপন রেখে কন্যা দেখতে যান । গরীব ঘরের সুন্দরী কন্যার বাবা এতো বড় ঘরে মেয়ে বিয়ে দেয়ার আনন্দে কোন খোঁজ খবর নেয়ার দরকার মনে করেননা । তাছাড়া মা মরা মেয়ে সহজে কেউ বিয়ে করতে চায়না । দাদার গ্রামে নিজের একটা সন্মান আছে , সেই সন্মানকে সন্মান করে খোঁজ না নিয়ে আমার নানা তার মা মরা মেয়েকে বিয়ে দেন । সেই সুন্দরী কন্যাটি আর কেউ নন , পরবর্তীতে তিনি আমার মা হন। আমার দুখিনি মা !

বাবার বিয়ের ৪ বছর পরের এক গরমে আমার জন্ম , বাবা তখন অপ্রকিতস্থ পাগল । বাড়ির পেছনের আম গাছে তাকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয় । মা আমাকে বুকের দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বাবাকে গোসল করান , ভাত মেখে লোকমা তুলে খাওয়ান । রাতে শিকল খুলে গা মুছে ঘরে এনে মশারী টানিয়ে ঘুম পাড়ান । মা একই সাথে যেনো দুটি শিশুর যত্ন করেন ।

আমার জন্মের পর কেউ কেউ নাকি বাবাকে টিপ্পনী কাটতো - রইস্যা পাগলা জাতে মাতাল, তালে ঠিক । পাগল হইলেও ঠিকই বউ চিনে আবার পোলাও জন্ম দেয়, হি হি হি ।

এসব মা গায়ে মাখতেননা , মা আমাকে আর বাবাকে শিশুর মতো যত্ন করতেন । দাদার বিশাল সম্পত্তির মালিক বাবাও । কেউ কেউ চাইতেন পাগলের সংসার না করে মা আমাকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফেরত যাক । মা আমার বাবাকে অন্ধের মতো ভালোবাসতেন , পাগল স্বামীকে একদন্ড চোখের আড়াল করতেননা ।

একটু যখন বড় হলাম বাবার পাগলামীও পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেলো , এখন শীতেও পাগল হন, গরমেও হন । যখন তখন যেখানে সেখানে পেশাব পায়খানা করে কচলে হাত নোংরা করেন , কাঁদা মাটিতে গড়াগড়ি করে শরীর মেখে রাখেন, মা এতোটুকু বিরক্ত না হয়ে বাবাকে সাফ করেন । আমি নাক কুচকে মায়ের কাজ দেখি , মাঝে মাঝে বালতি ভরে মাকে পানি তুলে দেই । ভেবে পইনা- মায়ের ঘেন্না করেনা এসব সাফ করতে ? এসব সাফ করে খেতে বসলে মায়ের হাতে গন্ধ লাগেনা ? অবাক হতাম এর কোনটাই মায়ের নেই !

একবার বাবার সারা শরীরে ঘা হয়ে পুজ জমে পোকা ধরে গেছিলো , মা কতো যত্ন করে গরম পানিতে লবন মিশিয়ে বাবাকে নরম কাপড়ে ডলে ডলে গোসল করাতো । পুজের ভেতরের পোকা বের করে মলম লাগাতো , আমি দূরে দাড়িয়ে ঘোন্না নিয়ে দেখতাম আর ভাবতাম - আমার মায়ের কোন ঘেন্না নাই কেনো ? সাদা সাদা পোকা বের করতে মায়ের সত্যিই ঘেন্না লাগেনা ? এই পুজ আর পোকা ঘেটে মা খাওয়ার রুচি পায় কই ? একটা বদ্ধ উন্মাদ মানুষের উপর মায়ের এতো ভালোবাসা জন্মে কেমন করে ?

মাঝে মাঝে শিকল খুলে বাবা কোথায় যেনো গায়েব হয়ে যেতো । আমি আর মা মিলে হন্যে হয়ে এপাড়া ওপাড়ার ঝোপ ঝাড়ে বাবাকে খুজে পেতাম , ঝোপে বসে বাবা একা একা কার সাথে যেনো কথা বলেন, নখে মাটি খুটে বিড়বিড় করেন । হঠাত আমাদের দেখে অচেনা মানুষের মতো কপালে হাত ঠুকে সালাম দিতেন । জোড় করে আমরা বাবাকে বাড়ি এনে বিছানায় শুইয়ে পায়ে শিকল বেধে দিতাম । এতো বছরে মা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন ।

একবার মায়ের খুব জ্বর হলো , উথাল পাথাল জ্বর । জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেন - বাজানরে তোর বাপের শিকল খুইল্যা দে, হের পায়ে ঘা হইয়া গেছে, ও বাজান হেরে আর কষ্ট দেস ক্যান ? পাগল মানুষটারে হুদাহুদি কষ্ট দেস ক্যান ? হেরে ছাইড়া দে বাজান , আহারে মানুষটা কি কষ্ট পাইতাছে ! মা সুর করে বিলাপ করেন । আমি কিছু না বুঝে মায়ের আদেশ পালন করি । শিকল মুক্ত হয়ে বাবা কোথায় যেনো হারিয়ে যান।

প্রবল জ্বরের ঘোরে মা বাবার গোঙানোর শব্দ না পেয়ে আমার কাছে জানতে চান - তোর বাবার শব্দ পাইনা ক্যান , হেয় এমুন চুপ মাইরা গেলো ক্যান ? বাজানরে হের গলার জবান গেলো কই ? হেয়তো এমন চুপ মাইরা থাহেনা ! অহন রাও শব্দ পাইনা ক্যান ?

দুরু দুরু বুকে মায়ের ছেড়া কাঁথার বিছানার পাশে দাড়িয়ে বলি - মা তুমি না কইছিলা বাজানের শিকল খুইল্যা দিতে ? - হ কইছিলাম , তয় হের রাও শব্দ নাই ক্যা ? - শিকল খুইল্যা আমি ইস্কুলে গেছি, আইয়া দেহি বাজানে নাই ! - ও বাবারে ! এইডা তুই কি কইলিরে এ এ ।

মা গায়ের কাঁথা ছুড়ে বাড়ির বাইরে দৌড় দিলেন , মায়ের পেছন পেছন আমিও দৌড়াই । নিঃস্বাস বন্ধ করে দৌড়েও আমি মায়ের অনেক পেছনে পরে থাকি । মা দিক বিদিক ছুটে বাবাকে খুঁজেন । কয়েক গ্রাম , আত্মীয় বাড়ি খুঁজেও বাবার খোঁজ পাইনা । বাবার খোঁজ না পেয়ে মা রোগে শোকে পাথর হন ।

৩/৪ বছর পর তাহের চাচা খবর দেন বাবাকে জিনার্দী রেল ষ্টেশনে বসে আপন মনে বিড় বিড় করতে দেখেছেন । তাহের চাচা অনেক চেষ্টা করেও বাবাকে তাকে চেনাতে পারেননি । বাড়ি ফেরানোর চেষ্টা করেও পাগল মানুষটাকে আনতে পারেননি ।

খবর শুনে মা আর আমি জীনার্দী ষ্টেশনে ছুটে যাই , অনেক খুঁজেও বাবার খোঁজ পাইনি । দু একজনের কাছে শুনেছি একটা পাগল মাঝে মাঝে ষ্টেশনে বসে একা একা বিড় বিড় করে, দোকানে চেয়ে চিন্তে শুকনো পাউরুটি, সিগারেট নিয়ে উধাও হয়ে যায় । কারো প্রয়োজন পরেনা তাই তার অবস্থান কারো জানা নেই । ২/৩ দিন অপেক্ষা করে আমরা ফিরে আসি ।

মা আজকাল কারো সাথে তেমন কথা বলেননা, নিরবে নিভৃতে সংসারের কাজ করেন । সামনে আমার এইচ, এস, সি, ফরম ফিলাপের টাকা জোগানোর চিন্তা মায়ের মাথায় ঘুরপাক করে । গ্রামের বাড়ির জমিতে ফসল ফলাতে একজন পুরুষ মানুষ লাগে , আমার মায়ের সেই মানুষটা নেই । দাদার কাছ থেকে পাওয়া জমি সারা বছর খালি পরে থাকে। চাচারা যখন গোলা ভরে ফসল তোলে আমাদের গোলা তখন শুন্য । একই জমির ভাগীদার চাচারা সারা বছর ধান বিক্রির টাকায় স্বচ্ছল , আমরা মা ছেলের পেটের দানার অভাব ! চাচাতো ভাই বোনেরা ফসল বেচার টাকায় মেলায় গিয়ে রঙিন খেলনা কিনে আনে , আমি টলোমলো চোখে ওদের হৈ হৈ করে মেলায় যাওয়া দেখি । আমার চোখে মুখে মেলায় যাওয়ার আকুতি দেখে মা আড়ালে চোখ মুছেন ।

চাচারা আমাদের অন্নের ভার নিতে চাইবেন কেনো ? অবশ্য বাবার ভাগের জমির বিনিময়ে ছোট চাচা আমাদের ভাতের ভাগ দিতে চেয়েছেন , মা চাচার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন । আমার মা ধৈর্য হারা হননি , বাবার সম্পত্তি হাতছাড়া করেননি । কতোটা সাহস বুকে থাকলে সন্তানসহ অভূক্ত থাকার ভয় আমার মাকে কাবু করেনি ভেবে অবাক হই ! আমার মায়ের বুক ভরা এতো সাহস কোথা থেকে পান ভেবে আজো অবাক হই !

ভাগ্য ভালো যে মা ভালো কাঁথা সেলাই জানেন , আমাদের দায়িত্ব মা কাঁথা সেলাইয়ের সুতোর সাথে গেথে নিলেন । গ্রামের বউ ঝিরা জানতো মা নিপুন হাতে কাঁথা সেলাইয়ে দক্ষ , সেই সুবাদে অনেকেই কাঁথা সেলাই করতে দেয়, মা আনমনে কাঁথা সেলাই করেন । মা নকশি কাটা ফুলতোলা কাথা বানায়, সুই সূতায় কাজ করেন আর গুনগুন করে গান করেন - সোনা বন্ধুরে আমারে পাগল বানাইলা।

আমি ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছি , পড়ার টাকা জোগাড় মায়ের একার পক্ষে সম্ভব না । কজন বন্ধুুর সাহায্যে ২/৩ টা টিউশানি জোগাড় করেছি । ওদের পড়িয়ে আমার পড়ার টাকা হয়ে বেশ কিছু টাকা বেচে যায় । মা গ্রামে একা থাকেন , সব সময় ভয়ে থাকি - কখন কি হয়ে যায় ।

চাচাদের সাথে পরামর্শ করে জমি জমা এক বছরের জন্য ভাড়া ( পত্তন) দিয়ে মাকে নিয়ে ঢাকা থাকার মোটামুটি টাকা হয়ে যায় হিসাব করে পরের মাসে মাকে নিয়ে এলাম।

এক ধনীর চিলেকোঠায় আমরা মা ছেলের নতুন সংসার শুরু হয় । একটা চৌকিতে আমাদরে মা ছেলের চলে যায় । পুরানো দুটো চেয়ার ১ টা টেবিল কিনে নিলাম পড়ার সুবিধার জন্য । হাড়ি পাতিল, বালতি কড়াই সহ সংসারের মোটামুটি জিনিস নিয়ে মা তার স্বামীর ঘরে তালা দিয়ে আমার কাছে এসেছেন।

মা নিরবে সংসারের কাজ করেন , বটিতে আনাজ কাটার সময় হাত কেটে রক্ত ঝরে, সেই রক্ত আমার অগোচরে আচলে মুছে নেন । মায়ের কেনো এমন ভুল হয় আমি বুঝতে পারি , বাবার জন্য বাবার সংসারের জন্য মায়ের হাহাকার আমি বুঝি । মায়ের চোখে সব সময় দেখি তার নিজের সংসারের হাহাকার , বাবাকে খুঁজে না পাওয়ার হাহাকার ।মা মুখ ফুটে বলেননা, মায়ের চোখের ভাষা আমার বুঝতে অসুবিধা হয়না, মায়ের চোখের ভাষা আমি পড়তে পারি ।

আমরা মা ছেলে পান্তা ভাতে পেয়াজ মরিচ ডলে প্রতিদিনের মতো আজও সকালের নাস্তা সেরে ক্লাশে যেতে তৈরী হচ্ছি , মা আমার কপালে চুমু খেয়ে বলেন - বাজানরে ক দেহি তুই কিয়ের ডাক্তার হবি ? - আগে ডাক্তরী পাশ কইরা লই মা , দোয়া কইরো বেশি বেশি পাশ দিয়া য্যান বড় ডাক্তার হই । - হ বাজান তোর লাইগা আল্লার কাছে কতো দোয়া করি ! - মাগো তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আমার লাইগা দোয়া আর কে করে মা ! - কইলিনা বাজান কিয়ের ডাক্তার হইবি ? - আল্লায় যেইডা কপালে রাখছে মা ! - আইচ্ছা বাজান পাগলের ডাক্তার হওন যায়না ? পাগল মানুষটিরে বালা করন যায়না ? হেগো বউ বাচ্চার লাইগা মায়া বাড়ানের ওষুদ দেওন যায়না ?

আমার বুঝতে অসুবিধা হয়না বাবার জন্য মায়ের প্রাণ কতোটা কাঁদে । নিরবে সংসারের, আমার কাজ করে গেলেও মায়ের মন বাবার জন্য আকুলি বিকুলি করে । বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় মা সময় গুনে , এখনও আশা করেন বাবা ফিরে এসে মাকে চমকে দিবেন । পাগল স্বামীটাকে ভালোবেসে মা সংসার করবেন ।

মেডিক্যালের ১ম বর্ষের এনাটমি ক্লাশে এক সময় একটা কঙ্কাল কেনা জরুরী হয়ে যায় । বড় ভাইয়াদের কাছে শুনি আমাদের পরেশ ডোম কঙ্কাল জোগাড় করে দেয় । পরেশ ডোমের শরনাপন্ন হলে তিনি জানালেন ২/৩ মাস অপেক্ষা করতে হবে ।

তিনমাস পর পরেশ ডোম বড় পলিথিনে মুড়িয়ে পাওনা টাকা বুঝে একটা কঙ্কাল আমাকে দিলো । বাসায় ফিরে কঙ্কালটা চৌকির তলায় রেখে রোজকার কাজ করি । ৩/৪ দিন পর ঘরে ফিরে দেখি মা নাকে আচল গুঁজে ওয়াক ওয়াক বমি করছেন । আমাকে দেখে যেনো মায়ের প্রাণ এলো । বলেন - দেখতো বাবা কিয়ের জানি গন্ধ ! পেট মোচড়াইয়া বমি আইতাছে !

কঙ্কালটা রোদে দিতে হবে ভুলেই গেছিলাম , মায়ের কথায় মনে হলো - আরে মা , তোমারে কইতে মনে নাই ! চৌকির তলে একটা কঙ্কাল রাখছি । - ওমাগো ! এইডা কি কস্ ? চৌকির তলে কঙ্কাল ক্যারে ? - ডাক্তারী পড়তে কঙ্কাল লাগে মা , ও মা কাইলকা তুমি এইডারে ছাদে শুকাইতে দিও কেমন? - আইচ্ছা । - ভুইল্যা যাইবানা তো ? - নারে বাজান ! ভুলমু ক্যারে ?

পরদিন ক্লাশ থেকে ফিরে দেখি মা কঙ্কালটা রোদে দিয়ে গালে হাত রেখে ভাবনার জগতে । পেছন থেকে জাপটে ধরলে মা হকচকিয়ে যান, বলেন - তোর বাপের শইলডা এমুন লম্বা আছিলো , হের কঙ্কালডাও এতো লম্বা হইবো । আইচ্ছা বাজান তোর বাপের আর খবর লইবিনা ? মায়ের কথায় আৎকে উঠি ! এইটা আসলেই আমার বাবার বেওয়ারিশ লাশের কঙ্কাল নয় তো ?

ছুটে যাই রমেশ ডোমের কাছে , জানতে চাই - কাকা সত্যি করে বলেন এই কঙ্কাল কোথা থেকে জোগাড় করেছেন ? - এইডা তো কওন যাইবোনা বাবা । - কাকা আপনার পায়ে ধরি , কেউ জানবেনা, কাউকে বলবোনা । আমাকে একটু দয়া করেন কাকা !

মাতাল রমেশ ডোমের মধ্যে মায়ার চিহ্ন দেখি , একটু এগিয়ে এবার সত্যিই তার পায়ে ধরি । রমেশ ডোম একটু একটু করে বলতে থাকে - বাবারে মানুষ যহন মইরা যায় তহন আমাগো কাছে হের পরিচয় অয় লাশ নামে । আমরা আশায় থাহি হেগো আত্মীয় স্বজন কহন আইয়া তাগো লাশ নিবো । কোন কোন লাশের কপাল খারাফ অইলে হেগো স্বজন আহেনা , হেরা অয় বেওয়ারিশ । রশিদ পাগলা আছিলো তেমন একজন বেওয়ারিস । হেয় বহু বছর হাসপাতের বারিন্দায় বইয়া বিড়বিড় কইরা নিজে নিজে কতা কইতো । কেউ খাওন দিলে খাইতো , না দিলে না খাইয়া বারিন্দায় গুমাইতো । - কাকা উনার নাম যে রশিদ তা জানতেন কেমনে ? - হেয় বিড়বিড় কইরা কইতো - হে হে রশিদ পাগলা , বিড়ি খাইবিনা ? তহন বুজতাম হের নাম রশিদ । - তারপরে কি হইলো কাকা ? - রশিদ পাগলার একদিন বেদম জ্বর অইলো , ডাক্তার ছাড়েগো কইয়া হেরে মেডিকেলো বর্তী করাই । ৩/৪ দিনের জ্বরে রশিদ পাগলায় মইরা যায় । হের লাশ ১ মাস লাশগরে থাইকা পোকে দরে । হেই লাশের কঙ্কালডা তোমার কাছে বেচছি বাবা ।

আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আমাদের চিলেকোঠার সংসারে ছুটে আসি , মা তখনও কপালে বাম হাত রেখে ডানহাতে কঙ্কালে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করছেন । মাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরি , ফিসফিস করে বলি - মা, মাগো বাবার খোঁজ পাইছি। মা নিষ্প্রান ঘোর লাগা চোখে আমাকে দেখেন , আরো জোড়ে মাকে বুকে চেপে ধরি - মা তুমি কিছু হোননা ? ও মা কি কইতাছি হোননা ? - আমিও পাইছি , এই হাড্ডির মইদ্দে তর বাপের গেরান পাইছি !

বাবার কঙ্কালটা মা প্রাণ ভরে আদর করুক , বুকে জড়িয়ে কেঁদে হালকা হোক । চিৎকার করে কেঁদে বুকের জমানো কষ্ট হালকা করুক। আমিও নিরিবিলি কোন জায়গা খুজে বুক উজার করে ক্ষানিক কেঁদে নেই !

এই ইট শুরকীর শহরে এমন কোন নিরিবিলি জায়গার খোঁজে আমি পথে নেমেছি , জানিনা খুঁজে পাবো কিনা............................ !!!!!!!!!

( আমার ছেলে ডাক্তারী ভর্তি হওয়ার পর তার এনাটমি ক্লাশের জন্য একটা কঙ্কাল কিনতে হয় ।লম্বা এই কঙ্কালটা দেখার পর আমার মনে হতো এই মানুষটার নিশ্চয়ই সংসার ছিলো , সন্তান ছিলো এবং এটা একটা বেওয়ারিশ লাশের কঙ্কাল । সেই থেকে এই গল্পটা আমার মাথায় ঘুরপাক করে । অনেক বছর পর আজ এই কঙ্কালটা নিয়ে লিখলাম।। )

14 comments

Recent Posts

See All

14 comentarios


labonno Dip
labonno Dip
24 ago 2020

খুবই আকর্ষণীয় গল্প…

Me gusta

Farjana 88
Farjana 88
24 ago 2020

গল্পটি পড়ে অনেক ভালো লাগলো

Me gusta

Musharof69
Musharof69
24 ago 2020

অসাধারণ, গল্পটি পড়ে খুবই ভালো লাগছে

Me gusta

Taha Raye
Taha Raye
24 ago 2020

ধন্যবাদ ভাইয়া এই গল্পটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য

Me gusta

Naymur68
Naymur68
24 ago 2020

এরকম গল্পগুলো পড়তে অনেক ভালো লাগে

Me gusta
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page