কর্মযোগ ১ম পর্ব
জীব মাত্রই সকল অবস্থায় কায়, মন ও বাক্যের দ্বারা কোন না কোন ভাবে যা কিছু করে তাই কর্ম। কেননা, "কর্মহীন হলে শরীর যাত্রাও সম্পন্ন হয় না-গীতা ৩/৮।" তাছাড়া, "কর্ম না করে কেউ ক্ষণকালের জন্যও থাকতে পারে না-গীতা ৩/৫।" যখন জীব গভীর নিদ্রায় নিদ্রা যাপন করে, তখনও তারা গ্রহণকৃত খাদ্য পরিপাক করে, রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়া ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া চলতে থাকে। কেননা, জ্ঞাত ও অজ্ঞাত অবস্থায়ও "সকল কর্ম ত্যাগ করা কোন জীবের পক্ষেই সম্ভব নয়-গীতা ১৮/১১।" কেননা, "জম্ভায়াতা অন প্নসঃ অর্থাৎ কর্মহীনা জীব নষ্ট হয়ে যায়-ঋগ্বেদ ২/২৩/৯।" জীব জগতে টিকে থাকার জন্য জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চলছে, আর এই সংগ্রামের নামই হল 'কর্ম'।
কোন জীবই কেবল মাত্র বেঁচে থাকার জন্য সকল কর্ম করে না। উপরন্তু সে কর্মের সাহায্য জ্ঞাত বা অজ্ঞাতাসারে চেষ্টা করে তার দুঃখজনক, সীমাবদ্ধ ও অপূর্ণ জীবনের গণ্ডি অতিক্রম করে, সুখদায়ক অসীম ও বন্ধনহীন এক পরিপূর্ণ জীবন লাভ করতে। তারা চায় সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে জীবন যাবন করতে। অতি ক্ষুদ্র পরমাণুসম জীব থেকে শুরু করে মনুষ্য পর্যন্ত সকল জীবই মুক্তি লাভের জন্য সর্বদা কর্ম করছে। আর সেই মুক্তি লাভের তাড়নায় সাধু ব্যক্তি সৎ কর্ম করেন এবং অসাধু ব্যক্তি অসৎ কর্ম করে। সকল দুঃখযুক্ত বন্ধন বিমুক্তিই সকল জীবের সকল ভালো মন্দ কর্মের একমাত্র লক্ষ্য।
কর্মযোগ মানুষকে কর্মের দ্বারা সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ দেখায়। কর্মযোগ শিক্ষা দেয়- যেহেতু কর্ম ব্যতীত কারোই জীবন ধারণ অসম্ভব, তাই এরূপ কর্ম কর যেন বন্ধন থেকে মুক্ত থাকা যায়। আত্মজ্ঞান লাভের অনুকূল কর্ম ভিন্ন সকল কর্মই সংস্কার উৎপাদন করে বিধায় তা বন্ধনের কারণ। পক্ষান্তরে, কর্মযোগের রহস্য জানা থাকলে এই বন্ধনকে রোধ করা যায়। এরূপ কর্মের কৌশল শিক্ষা প্রদান করাই কর্মযোগের উদ্দেশ্য। তাই বেদে উক্ত হয়েছে, "যে ব্যক্তিরা যজ্ঞময়ী(কর্মময়ী) নৌকায় আরোহন করতে সক্ষম হয় না(কৌশল জানে না), তারা অপবিত্র আচরণকারী হয়ে ইহ জগতেই বারংবার অধঃপতিত হতে থাকে-ঋগবেদ ১০/৪৪/৬।" কেননা, "কর্মের কৌশলই হল যে যোগ-গীতা ২/৫০।"
কর্মের কৌশল জানতে হলে সবার প্রথমেই কার্য-কারণ সম্বন্ধে জানা আবশ্যক। চেতন-অচেতন এবং স্থুল-সূক্ষ্ম কারণ তথা জগতের সব কিছুই কার্য-কারণের নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিশ্ব প্রকৃতির সকল ক্রিয়াই এই নীতি অনুসারে পরিচালিত। এই কার্য-কারণতত্ত্ব অনাদি ও অনন্ত। ঈশ্বর কোন জীবেরই সুখ দুঃখ বা পাপ-পূণ্যের জন্য দায়ী নয়। কেননা, "তিনি কারো পাপ বা পূণ্য গ্রহণ করেন না-গীতা ৫/১৫।" জীব তার নিজ কর্মের ফল স্বরূপ সুখ ও দুঃখ ভোগ করে এবং এর জন্য তারাই সম্পূর্ণ রূপে দায়ী। কেননা, "পরমাত্মা জীবের কৃত কর্ম, কর্মফল প্রাপ্তি ও কর্মফলের সংযোগ সৃষ্টি করে না। কিন্তু প্রকৃতির স্বভাব বশতই এগুলো জীবের উপর প্রবর্তীত হয়- গীতা ৫/১৪।" যে যেরূপ কর্ম করে, সে সেরূপ ফল ভোগ করে। জগতের কোন শক্তিই এর ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে না।
কর্মযোগের রহস্য জানতে হলে কার্য-কারণ নীতির বোধগম্য হওয়ার পরই কোন কর্ম সৎ ও কোন কর্ম অসৎ তা জানা আবশ্যক। গীতায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ "ভগবানের প্রীতির জন্য নিষ্ঠা সহকারে যজ্ঞ, তপস্যা ও দানকে সৎ কর্ম এবং অশ্রদ্ধা সহকারে এই সকল কর্ম ও অন্যান্য কর্মকে অসৎ কর্ম বলে নির্দেশ করেছেন-গীতা ১৭/২৭-২৮।" তিনি বলেছেন- "আসক্তি ও ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে এই সকল সৎ কর্ম করা উচিৎ-গীতা ১৮/৬।" কারণ, "এই সকল সৎ কর্ম সমূহ মনীষিগণেরও চিত্তকে শুদ্ধ করে-গীতা ১৮/৫।"
জগতে কোন কর্মই সম্পূর্ণ রূপে সৎ বা সম্পূর্ণ রূপে অসৎ নয়। সকল কর্মই কোন না কোন ভাবে সদসৎ মিশ্রিত। তাই এই সকল কর্ম কোন না কোন কালে ভালো ও মন্দ উভয় ফলই প্রদান করে। কেননা, "অগ্নি যেমন সর্বদাই ধূম যুক্ত থাকে, ঠিক তেমনি সকল কর্মও কম বেশী দোষযুক্ত থাকে-গীতা ১৮/৪৮।" মনুষ্য যেমন শরীরে রোগ জীবাণু নাশ করার জন্য ঔষধ প্রয়োগ করে জীবাণু গুলোকে ধ্বংস করে তার রোগ দূর করে সুস্থ হয়ে উঠে। ঠিক ঐ সময় তা জীবাণুর পক্ষে মৃত্যুর কারণ। বস্তুত জগতে এরূপ কোন কর্ম করা সম্ভবই নয়, যার ফল সম্পূর্ণ রূপে ভালো বা সম্পূর্ণ রূপে খারাপ। সকল কর্মই ভালো খারাপের সমন্বয়ে উৎপন্ন। তবুও যে সকল কর্মে ভালোর আধিক্য বেশী এবং যে কর্ম সমূহে খারাপের আধিক্য কম তাকে সৎ কর্ম রূপে বুঝতে হবে। পূর্বে উক্ত ফলের আকাঙ্ক্ষা বর্জিত যজ্ঞ, তপস্যা ও দান আদিতে সৎ এর আধিক্য বেশী বলে এগুলো সৎ কর্ম নামে পরিচিত। তাই, এরূপ ক্ষেত্রে সৎ অসৎ এর আধিক্য-অনাধিক্যই সৎ-অসৎ কর্ম নির্ণয়ের একমাত্র মানদণ্ড।
যদিও সকল কর্ম দোষযুক্ত তবুও ভগবান শ্রীকৃষ্ণজী "কর্ম ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন-গীতা ১৮/৪৮।" কারণ, "অকর্মা দস্যুঃ অর্থাৎ কর্মহীন অলস ব্যক্তি হল দস্যু-ঋগ্বেদ ১০/২২/৮।" তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, "পূর্ব কালের প্রাচীন মুমুক্ষুগণও(মুক্তি লাভের আশায় যারা সাধন ভজন করেন) কর্ম করেছেন, অতএব তুমিও কর্ম কর, কর্ম ত্যাগ করিও না-গীতা ৪/১৫।" বস্তুত, যিনি নির্বিকল্প সমাধি যোগে পরমাত্মা তথা ব্রহ্মে স্থিত হয়ে নৈষ্কর্ম অবস্থায় উপনিত হয়েছেন, তিনি ভিন্ন অপর কারো পক্ষে সম্পূর্ণ রূপে কর্ম ত্যাগ করা সম্ভব নয়। তাই, কর্ম যেহেতু করতেই হবে, সৎ কর্মের সাহায্যে মুক্তি লাভের চেষ্টা করা ব্যতীত মানুষের অন্য উপায় নেই।
কিন্তু অনেকেই মনে প্রশ্ন উৎপন্ন হয় যে, 'সৎ কর্মের মধ্যেও তো অসৎ কর্ম থাকে, তাহলে কেমন করে মুক্তি লাভ হবে'? প্রশ্নটি নিতান্তই অমূলক নয়, বরংচ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও শুভ অশুভ উভয় কর্মই দোষযুক্ত এবং কার্য-কারণ নীতির অন্তর্ভুক্ত বলে বন্ধনেরও কারণ। তাই মুক্তি লাভ করতে হলে এর বাহিরে যেতে হবে। কিন্তু কেহ ইচ্ছা করে উভয় কর্ম একেবারে বর্জন করে মুক্তি লাভ করতে পারে না। তাই, প্রথমে শুভ কার্যের সংস্কারের মাধ্যমে অশুভ কার্যের সংস্কার গুলোকে দূর করতে হবে। কারণ, "সুকর্মাণঃ সরুচো অর্থাৎ ভালো কর্ম যে করে সে যশস্বী হয়-অথর্ববেদ ১৮/৩/২২।" এরপর শুভ সংস্কারগুলোকেও সম্পূর্ণ রূপে ত্যাগ করতে হবে। এ যেন 'কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা'র মত ব্যাপার।
Comments