চতুরঙ্গ ও মোক্ষপতম্ ; বিশ্বক্রীড়ার বুদ্ধিযজ্ঞে হিন্দু সভ্যতার দুই উজ্জ্বল নিয়োগ
লুডু ও দাবা খেলার কথা আমরা কেই না জানি।কতিপয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হারাম খেলা বলতে চাইলেও বুদ্ধিদীপ্ত ক্রীড়াকৌশলে দাবা খেলার শ্রেষ্ঠত্ব সমগ্র বিশ্বে স্বীকৃত।অপরদিকে অবসরে নির্মল বিনোদনের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করার জন্য উপমহাদেশে লুডু খেলা অতি জনপ্রিয়।আমরা সকলেই এই দুই খেলার সাথে পরিচিত থাকলেও জানিনা এই দুইটি খেলার উৎপত্তি এই ভারতীয় উপমহাদেশেই।মহাভারতের কালে শকুনি ও যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলা আর যুদ্ধের পূর্বকালে শ্রীকৃষ্ণ- অর্জুনের যুদ্ধকৌশল পরিকল্পনার নিমিত্তে যে ক্রীড়া তাই আজকে লুডু ও দাবা খেলায় রুপান্তরিত হয়েছে প্রাচীন ভারতে যাদের নাম ছিল মোক্ষপতম্(লুডু) ও চতুরঙ্গ(দাবা)।আজ আপনাদের নিয়ে যাব সেই প্রাচীন সময়ে যেখানে আমরা দেখতে পাব কিভাবে এই খেলাদুটির সুচনা হয়েছিল।
মোক্ষপতম্(লুডু)
মোক্ষ মিলবে নাকি পতন হবে তার ই পূর্বে,মানবজীবনের এই প্রশ্নের সমাধানের ই ক্রীড়ারূপ মোক্ষপতম্ বা লুডু।আদিকালের মোক্ষপতম্ ক্রীড়ার বোর্ডটিতে সাধারণত ১০০ টি চৌকণা ঘর থাকত।ঘরগুলোর পদে পদে থাকত উন্নীত হবার সিঁড়ি অথবা তলিয়ে যাবার ফাঁদরূপ সর্পমুখ।
সিড়ি থাকত ১২ তম, ৫১ তম,৫৭ তম,৭৬ তম ও ৭৮ তম ঘরে।১২ তম ঘর বিশ্বাস,৫১ তম ঘর নির্ভরতা,৫৭ তম ঘর উদারতা,৭৬ তম ঘর জ্ঞান ও ৭৮ তম ঘর সন্ন্যাস বা বৈরাগ্যের প্রতীক।তাই এই সমস্ত ঘরে গুটি গেলে তা পূণ্যের ফলে সিড়িতে পড়ে উন্নীত হত উচ্চস্তরে।
৪১,৪৪,৪৯,৫২,৫৮,৬২,৬৯,৭৩,৮৪,৯২,৯৫ ও ৯৯ তম ঘরে থাকত সর্পমুখ। ৪১ অবাধ্যতা,৪৪ ঔদ্ধত্য, ৪৯ অশ্লীলতা,৫২ চৌর্যবৃত্তি, ৫৮ মিথ্যাচার,৬২ মাদকদ্রব্য আহার,৬৯ ঋণ,৭৩ হত্যা,৮৪ ক্রোধ,৯২ লোভ,৯৫ অহংকার ও ৯৯ ছিল কামের প্রতীক।আর তাই এই ঘরগুলোতে গুটি গেলে তা সর্পমুখে পতিত হত।
১০০ তম বা শেষ ঘর হল মোক্ষ বা ব্রহ্মলোকের প্রতীক,মোক্ষপ্রাপ্তি যেমন জীবনের গন্তব্য, মোক্ষপতম্ খেলোয়ারের ক্রীড়ার গন্তব্য তেমন ছিল মোক্ষের ১০০ তম ঘরে পৌঁছানো।
Amarendra Nath তার “Rakhigarhi, a Harappan metropolis in the Sarasvati Drishadvati divide” গ্রন্থে জানিয়েছেন প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই এই ধরনের খেলা প্রচলিত ছিল ভারতবর্ষে।হরপ্পা,মহেঞ্জোদারো, লোথাল,আলিমগড়, রাখিগড় সহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক শহরে এই ধরনের খেলার প্রাচীন চৌকণা বোর্ডের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে।তৎকালীন যুগে হাঁতির দাত,পাথর বা কাঠবাদামের বিচির মাধ্যমে এর গুটি প্রস্তুত করা হত।
প্রাচীন সময়ে এইসব খেলাকে ঘিরে অনেকসময় জুয়ার আসরও বসত।পবিত্র বেদে আমরা দেখতে পাই এই ধরনের জুয়া খেলাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে-
অক্ষৈর্মা দিব্য কৃষিমিত্কৃষস্ব বিত্তে রমস্ব বহু মন্যমানহ । তত্র গাবঃ কিতব তত্র জায়া তন্মে বি চষ্টে সবিতায়মর্যঃ ।।
ঋগ্বেদ ১০.৩৪.১৩
সরলানুবাদ- হে মনুষ্য,তুমি জুয়া খেলা থেকে বিরত থাক।কৃষিকাজ কর,গবাদিপশু আছে তোমার জন্য, পরিশ্রম কর।তোমার পরিবার সুখে থাকবে,তুমি যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাক,জুয়া খেলোনা।
মনুসংহিতা বলছে-
প্রকাশমেতৎ তাস্কর্যং যদ্দেবনসমাহ্বয়ো। তয়োর্নিত্যং প্রতিঘাতে নৃপতির্যত্নবান ভবেৎ।।
মনুসংহিতা ৯/২২২
জুয়া খেলা ও অর্থ নিয়ে বাজি ধরা এগুলো প্রকাশ্য চৌর্য বৃত্তি মাত্র।এই দুটিকে প্রতিহত করা রাষ্ট্রচালকের একান্ত কর্তব্য।
অন্ধ্রপ্রদেশে এই খেলাটি এখনো বৈকুণ্ঠপালি বা পরমপদ সোপান পতম্ নামে পরিচিত।তামিলনাড়ুতে বিষ্ণুভক্তরা বৈকুণ্ঠ একাদশীতে রাত জাগতে এই খেলাটি খেলে থাকেন যা সেখানে পরম পদম্ নামে পরিচিত।২য় খ্রিষ্টীয় শতক থেকেই খেলাটি বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করা শুরু করে এবং অনুমান করা হয় যে জ্ঞানদেব নামক একজন গণিতবিদ ত্রয়োদশ শতকে এই খেলাটিকে বর্তমান রূপ দেন।জৈনদের সংস্কৃতিতে এটি জ্ঞানচৌপড়(জ্ঞানের ক্রীড়া) নামে খ্যাত।
চতুরঙ্গ(দাবা)
পদাতিক,অশ্বারোহী,হাতিসৈন্য ও রথী,এই চার ধরনের সৈন্য নিয়ে যে লড়াইয়ের খেলা মহাভারতে তাই চতুরঙ্গ নামে খ্যাত।আজও আমরা দাবা খেলায় সৈন্য,হাতি,ঘোড়া ও মন্ত্রীদের (রথী) দেখা পাই।
চতুরঙ্গ খেলার বোর্ডটি ছিল নানা ধরনের।প্রধানত এটি অষ্টাপদ(৮*৮=৬৪) ঘরের বোর্ডে খেলা হত।৬ষ্ঠ শতকে বাণভট্টের হর্ষচরিতে অষ্টাপদে চতুরঙ্গ খেলার কথা পাওয়া যায়।তবে প্রাচীন ভারতে দশাপদ(১০*১০=১০০) ও সাতুরংকম্(৯*৯=৮১) ঘরের দাবা বোর্ডেরও প্রচলন ছিল।
ধারণা করা হয়ে থাকে গুপ্ত সম্রাজ্যের সময়(৩য়-৪থ শতক) এই খেলাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে।এরপর সিল্ক রোডের মাধ্যমে এটি দূরপ্রাচ্যে (চীন,জাপান,কোরিয়া) ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে এর নাম হয় জিনজিয়াং।৬ষ্ঠ শতকে আরবীরা পারস্য বিজয় করে এবং সেখানের স্থানীয়দের দমন করে নিজেদের রাজ্যপ্রতিষ্ঠার পর ভারতের সাথে তাদের ব্যাবসায়িক আদান প্রদান শুরু হয় আর সেই সুত্রেই ভারত থেকে চতুরঙ্গ খেলাও ইরানে গমন করে আর তার নাম হয় শতরঞ্জ।ফেরদৌসির এক বর্ণনায় ৬ষ্ঠ শতকে ভারতীয় এক বাণিজ্যদূতের মাধ্যমে পারস্য রাজসভায় এই খেলার প্রচলনের কথা পাওয়া যায়।
ভারতের ক্ষত্রম্রুত(রাজা মৃত বা পরাজিত) পারস্যে হয় শাহমাত যা স্পেনে মুসলিম সম্রাজ্যের বিজয়ের পর সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং পারসি শাহমাত হয়ে পড়ে ইউরোপ এর Checkmate(ShahMat). সেখানেই যুক্ত হয় রাণী,নৌকার মত নতুন গুটি।
মূলত চতুরঙ্গ ছিল একটি Battle Simulation Game যা প্রাচীন ভারতে যুদ্ধের পূর্বে রণকৌশল সাজানোর এক বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন হিসেবে ব্যাবহৃত হত।আর আজ সেখান হতে সমগ্র বিশ্বে আদরণীয় এই অসাধারণ কৌশলী খেলাটি।এভাবেই শুধু দর্শন,শাস্ত্রীয় বা বিজ্ঞানের দিকেই নয়,প্রাচীন ভারতের হিন্দু সংস্কৃতি বিশ্বকে জুগিয়ে গেছে অসাধারণ সব ক্রীড়াকৌশলও যার মধ্যে চতুরঙ্গ(দাবা),মোক্ষপতম্(লুডু),ক্রীড়াপত্রম্( তাস খেলা),কালারি(মার্শাল আর্ট) অন্যতম।
প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি জানুন,জ্ঞান ই আপনার সামনে খুলে দেবে আমাদের অতীত গর্বের অসংখ্য নবদ্বার আর তার স্ফুরণ আলোকময় করে তুলবে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎকে।
תגובות