পাঠাগার কেন প্রতিক্রিয়াশীলদের শত্রু?
ঢাকা জেলার দোহারের এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী কিভাবে তাদের পাঠাগারটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের পাঠাগারে কয়েকটি প্রগতিশীল বই খুঁজে পেয়েছিল। তাদের চাপে ও হুমকিতে উদ্যোক্তারা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছিল। আমাদের গ্রামে আমরা গত বছর ১ ফেব্রুয়ারি ‘ভাগ্যকুল পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ স্থাপন করে এমনই সমস্যার পড়েছিলাম। একাধিকবার উগ্রপন্থীরা দেখে যায় এখানে ধর্মবিরোধী কোন বই আছে কিনা? আমরা বহু সংখ্যক ধর্মগ্রন্থও রেখেছি, নিষিদ্ধ ও বিতর্কিত কোন বই-ই রাখিনি বলে রক্ষা পাই। এটি গঠন করার পরেই যখন প্রচুর শিক্ষার্থীরা বই নিতে আসতে থাকে তখন প্রতিক্রিশীলগোষ্ঠী প্রকাশ্যে হুমকি দিতে থাকে এবং সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমে অনবরত বিষেদাগার করতে থাকে- কেউ কেউ এটিকে নাস্তিকদের আখড়া হিসেবেও ঘোষণা দিতে থাকে। গত একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটি বই উৎসব করতে গেলে কতিপয় ব্যক্তি মাদ্রাসাগুলোতে গিয়ে মিথ্যা তথ্য রটিয়ে তাতে হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করতে থাকে। আমরা সফলভাবেই উৎসব করতে সক্ষম হই। মুন্সিগঞ্জে অনেকগুলো পাঠাগারই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের নিবন্ধিত। আমাদের পাঠাগারটি নিবন্ধন করাতে ব্যর্থ হই। অথচ যেগুলো সবসময়ই বন্ধ থাকে তারা ঠিকই নিবন্ধন করিয়ে নিয়েছে। পাঠাগার তালাবদ্ধ রাখাই যেন নিরাপদ। পাঠাগার গড়ে তোলার সম্মানও পাওয়া যায় আবার কারো বাধাও থাকে না। মুন্সিগঞ্জের গণগ্রন্থাগারে বছর দুই আগে গিয়ে এতোটাই হতাশ হয়েছিলাম যে, মনে হয়েছিল এখানে সাধারণ পাঠকের পাঠযোগ্য কোন বই-ই নেই।
পাঠাগার ধ্বংসের ইতিহাস সুপ্রাচীন। গ্রীক দার্শনিক প্রোটোগোরাস তার একটি গ্রন্থে বলেছিলেন, খোদাগণ আছেন আমরা তা যেমন বলতে পারিনা, তেমনি তারা নেই এমনও বলতে পারিনা। এমন আরেক বিষয় রয়েছে যা আমাদের সামনে তা প্রমানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রধান যে বিষয় তা হলো খোদ এ বিষয়টির অস্পষ্টতা এবং মানুষের স্বল্পায়ু। এই কারনেই খৃষ্টপূর্ব ৪১১ সালে তার গ্রন্থসমূহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এনে অগ্নি সংযোগে ভস্মীভূত করা হয়। ইতিহাসে গ্রন্থ ভষ্মীভূতকরণের প্রথম ঘটনা হিসেবে এটি বিধৃত হয়েছে। এছাড়া আরো কিছু গ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা আছে। যেমন: স্পেনের খৃষ্টানরা তদানীন্তন মুসলিমদের প্রায় আশি হাজার গ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়, ক্রুসেডের সময় খৃষ্টানেরা সিরিয়া-ফিলিস্থিনের কয়েকলক্ষ বই পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর তুর্কীরা মিশরে গ্রন্থাগার ধ্বংস করেন, সুলতান মাহমুদ গজনভী রেই শহরের গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেন, মোঘলরা বাগদাদে ও খোরাসানে গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দেন। জরথুস্ট্ররা সাসানী আমলে মাজদাকীদের গ্রন্থ সমূহ পুড়িয়ে দেন, রোমানরা প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ আরশমিদাদের গ্রন্থগুলো ভস্মীভূত করেন। বৌদ্ধদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার প্রথমে ধ্বংস করে হিন্দু সেন রাজারা পরে শেষ পেরেক ঠুকে দেন মুসলিম শাসকরা। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগার ধ্বংস করা।
আলেকজান্দ্রিয়ার রাজ-গ্রন্থাগার ছিল প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারগুলির একটি। এই গ্রন্থাগার ছিল মিশরের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার প্রতীক। সারা পৃথিবী থেকে বই ধার করে তার অনুলিপি তৈরি করা ও সেই বই গ্রন্থাগারে নিয়ে আসার জন্য এই গ্রন্থাগারে কর্মচারী নিয়োগ করা হত। অধিকাংশ বইই রাখা হয় প্যাপিরাস স্ক্রোলের আকারে। ধারণা করা হয় এখানে ৫ লক্ষাধীক বই ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পন্ডিতেরা সমবেত হতে থাকেন সেখানে। এই কেন্দ্রের শীর্ষ সময়ে এখানে ১৪০০ ছাত্রের সমাগম ঘটেছিল, আধুনিক মাপকাঠিতেও বলা যায় এটি ছিল বিশাল এক বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্র। এই আলেকজান্দ্রিয়াতেই ইউক্লিড তার জ্যামিতি আবিষ্কার করেন, ইরাতস্থেনিস পৃথিবীর পরিধি নিরূপন করেন, হেরোফাইলাস ও ইরাসিস্ত্রেসাস শরীরতত্ত্বে অসাধারন অগ্রগতি সাধন করেন, তেসিবাস আবিষ্কার করেন জলঘড়ি, হিপারকাস আবিষ্কার করেন নক্ষত্র অবিনস্বর নয়, ডায়োনিসিয়াস ছিলেন ভাষাতাত্ত্বিক, আরিস্টার্কাস আবিষ্কার করেছিলেন, পৃথিবী সধারণ একটি গ্রহ মাত্র। এটা পুস্তক প্রকাশকেন্দ্রও ছিল। প্রতিটি গ্রিক বইয়ের অনুলিপি ছাড়াও এতে ছিল আফ্রিকা, পারস্য, ভারত, হিব্রু ইত্যাদি অনেক দেশের অনেক ভাষার বই। বহু মূল বই ছিল এখানে। টলেমি রাজা বিপুল অর্থই ব্যয় করেছেন এই গ্রন্থাগারের পেছনে। এখানেই ছিলেন হাইপেশিয়া। ধর্মান্ধ খৃস্টান মৌলবাদীরা তাঁকে কি নৃশংসভাবেই না হত্যা করেছে! খৃস্টান মৌলবাদীরাই প্রথমে বারবার হামলা চালিয়ে, আগুন ধরিয়ে এর ক্ষতিসাধান করে এবং চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে মুসলিম মৌলবাদীরা।
হিরক রাজা চলচ্চিত্র থেকে দেখেছি রাজা কিভাবে লেখাপড়াকে ভয় করতো। তারা রটাতো-
লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে।
জ্ঞান অর্জন লোকসান, নাহি অর্থ নাহি মান।
জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।
কেন এমনটা বলতো তাও আমরা জানি। হিরক রাজারাও জানে, মানুষ-
‘যত বেশি জানে, তত কম মানে’।
প্রতারকচক্র বিভিন্ন রকম মিথ্যা গল্প সাজিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। তারা জানে মানুষ যদি শিক্ষিত হয়, সচেতন হয় তবে সর্বনাশ! তারা বুঝে ফেলবে মিথ্যাটা, ধরে ফেলবে ফাঁকটা। পাঠ্য বইতে তারা ‘মানুষের চোখ খুলে যায় এমন কিছু’ লেখা থাকে না। এসব লেখা থাকে আউট বই মানে পাঠাগারের বইতে। তাই পাঠাগার বন্ধ করতে তারা মরিয়া হয়ে উঠে।
Comments