বেখেয়ালের মহাকাল
- Just Another Bangladeshi
- Aug 6, 2017
- 6 min read
সন্ধ্যার পর মেয়েদের ফার্মেসিতে ঢুকতে দেখলে সবাই কেমন চোখে যেন তাকায়। হোক তা সাধারণ এলাকায়, হোক অভিজাত এলাকায়। সবার চোখে থাকে নোংরা আগ্রহ। নাহারের ওষুধ লাগলে পারতপক্ষে বিকালের আগেই নিয়ে রাখে। নয়তো লিয়নকে দিয়ে আনিয়ে নেয়। আজ লিয়ন অফিসে। ছেলেটার হঠাৎ ডিসেন্ট্রি দেখা দিলো। ঘরে ওষুধ নেই। দেড় বছরের ছেলেকে ওর দাদির কাছে রেখে নিচে নামে নাহার। বাসার নিচেই রাস্তার অপজিটে ফার্মেসি। চরম অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ওষুধ নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে। হঠাৎ থমকে যায় সে। ফার্মেসির পাশে রাস্তা ঘেঁষে এক বুড়ি শীতকালীন পিঠার দোকান দিয়েছে। অস্থায়ী লাকড়ির চুলা। চুলার সামনে ময়লা চাঁদর বিছানো একটা টেবিল। টেবিলে ছোট ছোট প্লেটে পিঠা সাজানো। টেবিলের পাশে একটা কাঠের বেঞ্চ। কাস্টমাররা পিঠা নিয়ে বেঞ্চে বসে খায়।

কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হয়েছে। অন্যসব দিন এই সময়ে পিঠার দোকানে থাকে উপচে পড়া ভিড়। আজ একদম ভিড় নেই। রাস্তাটাও কেমন ফাঁকা। কারণ পাশের গলিতেই উত্তরা ১৪ নং সেক্টর সেন্ট্রাল জামে মসজিদ। মসজিদে ওয়াজ মাহফিল চলছে। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ চলে গেছে ওয়াজ শুনতে। ভিড়হীন পিঠার বেঞ্চে চোখ আটকে যায় নাহারের। বেঞ্চের মাঝখানে পা গুটিয়ে একটা ছেলে বসে আছে। দুই পায়ের উপর বসে হাতে সবুজ রঙের প্লাস্টিকের প্লেট নিয়ে পিঠা খাচ্ছে। খাওয়ার ভঙ্গি কেমন মহনীয়। ছোট প্লেটটাকে বুক বরাবর ধরে রেখেছে বাম হাতে। ডান হাত দিয়ে ছোট ছোট টুকরা করে পিঠা ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে। মুখে দিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলছে। যেন অমৃত জাতীয় কিছু একটা মুখে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে তাকিয়ে থাকছে পিঠার দিকে। পৃথিবীতে যেন পিঠার প্লেট ছাড়া আর কোনো বস্তু নেই। আর কোনো বিষয় নেই। এত মনোযোগ দিয়ে চিতই পিঠার দিকে তাকিয়ে থাকে কে? অথচ এমন স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে তার তাকিয়ে থাকার হাজারটা যৌক্তিকতা আছে।
ছেলেটার গায়ে ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। পাশে, বেঞ্চে মোটা ফ্রেমের চশমা রাখা। নাহারের মনে হলো, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে কোনো ফেরেশতা। জীবনের প্রথম পিঠা নামক কোনো খাদ্য চেখে দেখছে। এত মনোযোগ দিয়ে যে কোনো কাজ কেবল একজনকেই করতে দেখেছে নাহার। শাফি! নাহার তার বিস্ময়ে আটকে যাওয়া মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল, ‘শাফি!’
শাফির এতে ভাবান্তর হলো না। হওয়ার কথাও না। নাহার তখনো বেশ দূরত্বেই ছিল। সে একবার হাতের ওষুধের দিতে তাকাল। একবার শাফির দিকে। সদ্য জন্ম নেওয়া দ্বিধার দেওয়ার ভেঙে এগিয়ে গেল পিঠার দোকানের দিকে। কাঠের বেঞ্চের এক পাশে বসলো আলতো করে। এতেও ভাবান্তর হলো না শাফির। সে গৌতম বুদ্ধের মতো গভীর ধ্যানে পিঠা খাচ্ছে। নাহার বসে রইল। হঠাৎ তাকে দেখে শাফির কী প্রতিক্রিয়া হয় দেখার তৃষ্ণা নিয়ে বসে রইল।
এই শাফি নাহারের জন্য কত হাজার ঘণ্টা বসে থেকেছে তার ইয়ত্তা নেই। সারারাত মোবাইলে কথা বলেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যাম্পাসের মাঠে সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে গল্প করে কাটিয়েছে। নাহারের মন খারাপ থাকলে মন ভালো না হওয়া পর্যন্ত কথার ফুলঝুরি ছুটিয়েছে। নাহারের বিয়ের কথা শুনে কত রাত বিনিদ্র কাটিয়েছে কান্নাসমেত। বিয়ের পর এক পলক দেখার জন্য কত ছটফট করেছে। হঠাৎ হঠাৎ ফোন দিয়ে হাউমাউ করে কান্না করেছে। একবার দেখা করার হাজারো আকুতি জানিয়েছে।
আজ সেই নাহার শাফির পাশে বসে আছে। শাফি ফিরে তাকাচ্ছে না। প্রার্থনার মতো মগ্ন হয়ে চিতই পিঠা খাচ্ছে। নাহারের একটু রাগ হলো। দায়িত্ববোধও জাগ্রত হলো কিছুটা। ছেলেটা অসুস্থ। যত দ্রুত সম্ভব একটা বেবি জিংক গুলিয়ে খাইয়ে দিতে হবে। ব্যর্থ প্রেমিকের সিগারেটের শেষ টানের মতো বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে উঠে পড়বে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। তখনই ফোন বেজে উঠলো শাফির। কোন এক আগ্রহে বসে রইলো নাহার। উঠলো না। সদ্য ছেঁড়া পিঠার টুকরা মুখে দিয়ে বেঞ্চের কোণায় হাত মুছে ডান পকেট থেকে মোবাইল বের করল শাফি। চোখের একেবারে সামনে নিয়ে ধরল। নাহার এতক্ষণে তাকে না দেখার ও তার দিকে না তাকানোর কারণ বুঝতে পারল। ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা শাফির দুই চোখ প্রায় খেয়ে ফেলেছে। ফোনের স্কিনে দুই তিন সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বাটন টিপে কল রিসিভ করল শাফি। তারপর বিছানায় শরীর এলিয়ে দেওয়ার মতো ডান হাতে ভর করে একটু কাত হয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে কথা বলল শাফি, -কিরে বন্ধু, এতদিন পর মনে পড়ল? ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল কল দেওয়া বন্ধু। গভীর মনোযোগ দিয়ে যেন তার কথা শুনছে শাফি। সেই সাথে একটু একটু হাসছে। এই প্রথম শাফির ঠোঁটের দিকে তাকালো নাহার। পুড়ে কেমন কালকূটে হয়ে গেছে। দেখে মানুষের ঠোঁট মনে হয় না। রাস্তার উল্টানো পিচ মনে হয়। ঠোঁটের সৌন্দর্য ম্লান হলেও হাসিটা রয়েছে আগের মতোই মহনীয়। ওপাশের কথা শোনা শেষ হলো। ঠোঁটের হাসি চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল শাফি, -আরে নাহ, উত্তরা কারো সাথে দেখা করতে আসিনি। আসছিলাম একটা অফিসে। জবের জন্য। এক বড়ভাই আসতে বলেছিল। রাস্তা ফাঁকা ছিল। খুব দ্রুত চলে এসেছি। বড়ভাই আসতে বলেছে সাড়ে আটটায়। আমি সাড়ে ছয়টায় চলে এসেছি। এখন দুই ঘণ্টা রাস্তায় বসে কাটাই। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ তীব্র কদমফুলের ঘ্রাণ নাকে আসল। এই হেমন্তে কদম ফুটবে কেন? গন্ধ আমি এমনিতেই পেলাম কি না বুঝতে পারছি না। হতে পারে মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে বলে উদ্ভট সব গন্ধ পাচ্ছি। সেদিন মাঝরাতে ওয়াশরুম থেকে শুটকি মাছ ভাজার গন্ধ আসছিল। ওয়াশরুমে কেউ শুটকি মাছ ভাজে? আমার তো গাছে কদম আছে কি না সেটা দেখার মতো দৃষ্টি নেই। সামনে দাঁড়ানো মানুষকেই স্পষ্ট দেখতে পাই না। মনে হয় একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে কদমগাছ বা গাছের কদম দেখা তো কল্পনাতীত। রাস্তার পাশে পিঠার দোকান আছে। একটা পিঠা খেতে খেতে কদমফুলের ঘ্রাণ নিচ্ছি।
কথা শেষ করে হাহা করে হাসলো শাফি। যেন প্রচণ্ড মজার কোনো কথা বলেছে। এবার ওপাশ থেকে কিছু একটা বলছে। শাফি হ্যাঁ-হু করে মাথা নাড়ছে। নাহারের কানে আর কোনো শব্দ যাচ্ছে না। একটা শব্দই শুধু প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ‘সামনে দাঁড়ানো মানুষকেই স্পষ্ট দেখতে পাই না। মনে হয় একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে।’
কী অসহায়ত্ব, কী কঠিন কথা। অথচ কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলছে শাফি। নাহারের মনে পড়ে, বিয়ের দুই আড়াই বছর পর একদিন কল দিয়ে অনেক কান্না করছিল শাফি। বলছিল, “একবার আমার সাথে দেখা করো। আমাকে একবার দেখতে দাও। প্রাণ ভরে তোমাকে শুধু দেখবো। তোমার কাশফুলের মতো হাওয়ায় ওড়া চুল, গাঙের চরের মতো টানটান কপাল, ব্লাকহোলের মতো চোখ আর ধনুকের মতো বাঁকা পাপড়ি দেখবো শুধু। হাত ধরার চেষ্টা করবো না মোটেও। প্লিজ একবার দেখা দাও।” নাহার সাড়া দেয় নাই। যে অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে সে অধ্যায়ের প্রতি মায়া রাখা দুজনের জন্যই যন্ত্রণার। দেখা করলে শাফি ইমোশনাল হয়ে যেতে পারে, একই সম্ভাবনা আছে নাহারেরও। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে লিয়নকে কী জবাব দেবে।
নাহার লিয়নকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি সত্য; বিয়ের পর তো ভালবেসেছে। মেয়েদের জামাইকে ভালো না বেসে উপায় থাকে না। শরীর শেয়ার করতে করতে একসময় মনও শেয়ার হয়ে যায়। বিয়ের প্রথম কয়দিন খুব কষ্ট হয়েছে নাহারের। কিন্তু খুব দ্রুত শাফির জন্য জমাকৃত ভালোবাসাকে কনভার্ট করে নিয়েছে লিয়নের দিকে। এজন্য শাফির কোনো আব্দারেই মন গলায়নি। আজ বুঝতে পারছে নাহার। কেন শাফি এত অনুনয়-বিনয় করেছে। কেন একটাবার দেখতে চেয়েছে। শাফি বুঝতে পেরেছিল ক্রমেই সে তার দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারিয়ে ফেলছে। আশ্চর্য! এ কথা শাফি কেন সেদিন নাহারকে বলল না? তাহলে নাহার যাই হোক, শাফির সাথে দেখা করতো। ফোনের ওপাশের কথা শেষ হয়। শাফি ডানে-বামে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে, -না রে, চলতে খুব একটা সমস্যা হয় না। পাঁচ বছর তো এভাবেই চলছি। কপালে যদি লেখা থাকে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, কার সাধ্য আছে তা আটকায়? এজন্য খুব একটা ভয় টয় করি না।
শাফি আরও কথা বলতে থাকে। সে কথা আর নাহারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। সে ভাবতে থাকে শাফিকে নিয়ে। একদিন শাফি অনেক চেষ্টা করেছে নাহারের সাথে দেখা করার। এখন নাহার শাফির পাশে বসে আছে। দেখতে পাচ্ছে না। সামনে দাঁড়ালেও দেখতে পাবে না। শাফি আর কোনোদিন নাহারকে দেখতে পাবে না। ভাবনাটা খুব সহজেই ভাবতে পারলো নাহার। কিন্তু সহজভাবে নিতে পারলো না। নাহারের ভেতরটা উলটপালট হয়ে গেলো। নীল নদের মতো বিশাল এক অপরাধবোধ জাপটে ধরলো তাকে।
নাহার দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মাথার উপরে তাকালো। একটা সদ্য যৌবন পাওয়া কদমগাছ ওদের মাথার উপরে। কদম গাছের ডাল ভর্তি ফুটে আছে গোল গোল ফুল। নাহার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এক শ্রেণির কদম গাছ বছরে দুইবার ফুল দেয়। বর্ষার শুরুতে, হেমন্তের মাঝামাঝি। এইটা সেই জাতের কদমগাছ। কদমফুলের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ পেলো নাহার। কদম নাহারের সবচেয়ে প্রিয় ফুল। শাফি কদম দেখতে পারতো না। তার প্রিয় ছিল মেহেদী ফুল। কদমকে কখনো ফুলের স্বীকৃতি দেয়নি শাফি। বলেছে, ‘বিকট গন্ধওয়ালা টেনিস বল। যার ফুল হবার কোনো যোগ্যতাই নেই। যে ফুলের কোনো ক্লাইটেরিয়াই পূরণ করে না।’ রবীন্দ্রনাথ আর হুমায়ূন আহমেদ আজাইরা এক ফুলকে যুবক-যুবতীর আবেগ বানিয়ে ফেলেছে বলে এই দুজনের উপর শাফির কী অভিমান। সেই শাফি আজ কদমের ঘ্রাণে থমকে গেছে। বসে পড়েছে কদমতলায়।
মানুষ কী অদ্ভুতভাবেই না বদলায়। নাহার যেমন বদলে গেলো বিয়ের পর। কদমগাছ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে আনে নাহার। শাফি সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে টাকা বের করে। পিঠাওয়ালার টাকা মিটিয়ে মোটা চশমাটা চোখে দিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। নাহার যেন গাছ হয়ে যায়। তার পায়ে শেকড় গজিয়ে যায়। শেকড় ক্রমেই পৌঁছে যায় পাতালপুরীতে। অপরাধবোধ আর কষ্টের শেকড় তাকে আকটে দেয় অসময়ে ফোটা কদম গাছের নিচে। দেবদূতের মতো সাদা মানুষটা হাঁটতে শুরু করে ফুটপাথ দিয়ে। ঝাপসা চোখে নাহার সেদিকে তাকায়। আবার তাকায় হাতের ওষুধের দিকে। দায়িত্ববোধ তাকে দ্রুত বাসায় যাওয়ার তাগিদ দেয়। মরে যাওয়া ভালোবাসা তাকে ঠেলতে থাকে শাফির গমনপথে। নাহার একবার ভাবে, সব বাদ দিয়ে বাসায় চলে যাবে। বাচ্চাকে বেবি জিংক গুলিয়ে খাওয়াতে শুরু করবে। আবার ভাবে, শাফির পেছন পেছন হাঁটবে। শাফি কোন অফিসে যায় দেখবে। কিংবা মাঝ পথে শাফির কাঁধে হাত রেখে থামিয়ে দেবে, ‘আমি নাহার, আমাকে দেখো শাফি, আমি তোমার নাহার’ বলে চিৎকার করতে করতে শাফিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরবে।
চোখের ফোটা ফোটা জলে নাহারের হাতের ওষুধের ব্যাগ ভিজতে থাকে। নাহার সেদিকে খেয়াল করতে পারে না। তার খেয়াল হারিয়ে গেছে বেখেয়ালের মহাকালে।
আমরা আজ এক বেহায়া জাতিতে পরিনত হয়ে গেছি