বেদে মূর্তিপূজা
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী বিবেকানন্দের আপাত বিরোধ এবং বৈদিক সিদ্ধান্ত
প্রথমে আমরা জানি, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কিংবা আর্যসমাজ মূর্তিপূজাকে ঈশ্বরোপাসনার পদ্ধতি হিসেবে মান্য করে না। আর্যসমাজ ইশ্বরোপাসনার মার্গ হিসেবে বেদকে প্রধান মান্য ধরে বেদ, উপনিষদ ও ষড়দর্শন স্বীকৃত পদ্ধতি সমূহ (নিষ্কাম কর্ম, নিষ্কাম দেবযজ্ঞ, শুদ্ধ জ্ঞান, যোগ, ঈশ্বরের নিরাকার স্বরূপে ভক্তি) সকল বিষয় মান্য করে থাকে। মূর্তি পূজাকে সাধনার পথ হিসেবে মান্য না করার কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। কারণ সমূহ উল্লেখ করা যাক। ১. প্রথমত বেদে মূর্তিপূজার সম্বন্ধে কিছু বলা নেই ( দুর্জনতোষণী নীতি অনুযায়ী ধরে নিলাম মূর্তির বিপক্ষেও কিছু নেই, যদিও দয়ানন্দ জী উল্টোটা প্রমাণ করেছেন)। আবার বেদের প্রধান কর্মকাণ্ড ব্রাহ্মণ ও শ্রৌতাদি সূত্রেও মূর্তিপূজা করার কোনো বিধান বা নিয়ম নেই। অমুক তিথিতে পূজা-তমুক তিথিতে পূজা ইত্যাদি। ২. জগতের সর্বত্র সবখানে ঈশ্বর আছেন। সেই ঈশ্বরকে আমরা সীমাবদ্ধ করেছি মূর্তিতে, বলছি তিনি শুধু এখানে আছেন, মূর্তির দিকে ফিরে শ্রদ্ধা কর ইত্যাদি। ৩. মূর্তিপূজার স্বীকৃতি উপনিষদে নেই, গীতাতেও সরাসরি মূর্তিপূজার ব্যাপারে কিছু বলা নেই (অনেকে সগুণ নির্গুণ উপাসনার সাথে বিষয়টা গুলিয়ে ফেলেন, আসলে সগুণ নির্গুণ উপাসনার ব্যাখ্যা সাকার নিরাকার না, আর সগুণ থাকলেও দেবতার মূর্তি বানিয়ে পূজার দৃষ্টান্ত প্রামাণ্য একাদশ বৈদিক উপনিষদ বা গীতাতে দেখা যায় না। ৪. মূর্তি বা বিগ্রহপূজার তথাকথিত অন্যতম অনুষঙ্গ হল প্রাণপ্রতিষ্ঠা। প্রশ্ন আসে, এই প্রাণপ্রতিষ্ঠা যদি ঈশ্বরপ্রেরিত বেদের মন্ত্র দিয়ে করা হত, তাও মানা যেত! সেটা করা হয় মানব রচিত শ্লোক দ্বারা! আর যে ঈশ্বর আমাদের প্রাণ দিয়েছেন, তার প্রাণ নাকি পুরোহিত গিয়ে প্রতিষ্ঠা করে! আর পুরোহিত প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পারলে মরা মানুষকে কেন জীবিত করে না!
৫. ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্র এটাই বলে ঈশ্বর সকল ঋতুতে পূজনীয়, তাহলে নির্দিষ্ট তিথিতে তার আরাধনা করা, আর বাকি দিনে না করা- এই ধারণাটা ও বেদের বিরোধী।
৬. ঈশ্বরের মূর্তি নেই এটা বেদ বা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের অত্যন্ত বিখ্যাত উক্তি এবং একইসাথে ঈশোপনিষদের বিখ্যাত উক্তি ঈশ্বর ছাড়া সম্ভূতি অসম্ভূতি অর্থাৎ এই প্রাকৃতিক জগতের অন্য কোন শক্তির উপাসনা করার প্রচেষ্টা বৃথা। গীতাতেও দেবতার উপাসনা কিংবা দেবযজ্ঞকে ফলদায়ক বলা হয়েছে ৭.২০-৭.২৩ এ, কিন্তু মোক্ষদায়ক বলা হয় নি।
এরকম নানা যুক্তি দ্বারা মূর্তিপূজার অসারতা ও নিম্নতা প্রমাণ করা যায়। সেটাই করেছেন মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী। কারণ তিনি বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ কেবল বেদের অনুসারী। তো বেদ বা ব্রাহ্মণ আদি থেকে মূর্তিপূজার নিয়ম, মন্ত্র সব দেখালে সে পূজা করতে আপত্তি কিসের! কিন্তু যেহেতু কোন বিধি বিধান নেই, এবং ধরে নিলাম সমর্থন ও বিরোধ নেই; তাই বেনিফিট অফ ডাউট হিসেবে তো সেই পথ অনুসরণ না করাই সর্বোত্তম। দয়ানন্দ জী সকলকে সেই উত্তম পথের সন্ধান ই দেখিয়েছেন।
এবার আসি স্বামী বিবেকানন্দ জীর প্রসঙ্গে।
আমরা সকলেই জানি এবং অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বামী বিবেকানন্দ প্রতীকের সাহায্যে পূজা করার পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, তিনি বেদের দোহাই দিয়ে এই পক্ষ অবলম্বন করেন নি বরং কল্পনা বলেই স্বীকার করে বলেছেন -"বেদে মূর্তিপূজার উল্লেখ নাই। স্রষ্টা এবং সখারূপে ঈশ্বরের অভাববোধের প্রতিক্রিয়া হইতেই শ্রেষ্ঠ আচার্যগণের মূর্তিকে ঈশ্বর কল্পনা করিয়া লওয়া হইয়াছে।"১
আমরা জানি, আমাদের একটি সর্বোচ্চ লক্ষ্য রয়েছে। আর সেটি হলো মোক্ষলাভ। মোক্ষ অর্জনে সাধনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যে পৌছতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "এই মূর্তিপূজা আমাদের সকল শাস্ত্রেই অধমাধম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে"২ এখন কথা হলো, এই অধমাধম উপায় নিয়েই কি আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌছতে পারব? পারব না, স্বামীজীরই কথাতে তা স্পষ্ট,-"যাহা হউক স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এই প্রতীক-পূজা আমাদিগকে কখনই মুক্তি দিতে পারে না;"৩ অর্থাৎ প্রতীকের সাহায্যে উপাসনাকে তিনি আল্টিমেট উপায় বলেন নি।
অপরদিকে এই প্রতীকের সাহায্যে উপাসনাতে বিপদের আশঙ্কা করে বলেছেন, -" দ্বিতীয়তঃ ইহাতে বিশেষ বিপদাশঙ্কা আছে। বিপদ এই যে, প্রতীক বা সমীপকারী সোপান-পরম্পরা যতক্ষণ পর্যন্ত আর একটি অগ্রবর্তী সোপানে পৌঁছিবার সহায়তা করে, ততক্ষণ উহারা দোষাবহ নয় বরং উপকারী, কিন্তু আমাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জন সারা জীবন প্রতীকোপাসনাতেই লাগিয়া থাকে।...লোকে মুখে বলিবে যে, এগুলি সোপান মাত্র—এই-সকল সোপানের মধ্য দিয়া তাহারা অগ্রসর হইতেছে, কিন্তু বৃদ্ধ হইলেও দেখা যায়—তাহারা সেই-সকল সোপান অবলম্বন করিয়াই রহিয়াছে।"৪
সুুুুতরাং স্বামীজীর মতে যারা বয়স্ক তাদের কি করা উচিত তা এখানে স্পষ্ট কিন্তু এ কথা কি কেহ শুনবে!! নাকি স্বামীজীর স্বীকার করা অধমাধম সোপানেই সারাজীবন পার করবে?
তথ্যসূত্রঃ ১। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, দ্বিতীয় খণ্ড, জ্ঞান যোগ কথা। ২।স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, পঞ্চম খন্ড, আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম। ৩,৪।স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাবলী", চতুর্থ খণ্ড, প্রতীকের কয়েকটি দৃষ্টান্ত।
অর্থাৎ আমরা বলতে পারি বিবেকানন্দ জী মূর্তিকে মেনেছিলেন মূলত কেন?
প্রথমত, বিরোধ না করার জন্য দ্বিতীয়ত, তিনি এই পদ্ধতিকে নিম্নতর বলে মেনেছিলেন এবং সাধারণ মানুষের প্রাথমিক অবলম্বন বলে মানতেন! কিন্তু আমরা যদি সারাজীবন ধরে নিজেকে ফেল করে রাখতে চাই, কিন্ডারগার্টেন লেভেল থেকে উপরে তুলতে না চাই নিজেকে, তাহলে কিভাবে আমরা এগোব?
আর মূর্তিপূজার সরাসরি বিরোধ করা হয় আর্যসমাজের পক্ষ থেকে; কারণ আমরা শুধু বেদের কথা মেনে থাকি। পুরাণ সমূহে মূর্তির কথা আছে বটে। কিন্তু পুরাণ না বেদ-উপনিষদ কোনটা আগে মান্য সেটা নির্ণয় করে তারপর যথার্থ পদ্ধতির অনুসরণ করাই একান্ত বিধেয় হওয়া উচিত।
Comments