ব্যবিলনে একদিন যুদ্ধ থেমেছিল
- Just Another Bangladeshi
- Aug 16, 2020
- 3 min read
Updated: Aug 24, 2020
"যুদ্ধের আগে তুমি কি করতে?"
সে রাইফেলের স্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। তারপর শীতল কন্ঠে বলে,"ইরাকে যুদ্ধের আগে বলতে কিছু নেই।" তারপর আবার স্কোপে চোখ রেখে বলে," এই জীবনের বাইরে,আমি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম।"

লেফটেন্যান্ট আবু আ'লা আল মারওয়ান। বয়স ৩০ ছুইছুই। তার বিশালদেহ আর চোখমুখে একটা কাঠিন্য আছে। তার গায়ের রঙ আরবের নিষ্ঠুর সূর্য পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার সাথে তার পরিচয় হয়, ২০১৭'র অক্টোবর মাসে। ইরাকজুড়ে তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল। একদিকে ইসলামিক স্টেটের জংগিরা আর আরেকদিকে ইরাকি সেনাবাহিনী আর শিয়া মিলিশিয়ারা। ইরাকে তখন শিয়া-সুন্নি সংঘাত একেবারেই নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা।
লেফটেন্যান্ট আবু আ'লা ইরাকি সেনাবাহিনীর গোল্ডেন ডিভিশনের সদস্য। শিয়া-সুন্নী দুই গ্রুপের ইরাকি আছে এখানে। ইরাকি বিশেষবাহিনীর কমান্ডে থাকা এই ডিভিশন তখন মসূল মুক্ত করতে লড়াই করছিল। যেই প্লাটুনের সাথে আমি সংবাদ সংগ্রহ করতে আছি,তাদের দলের স্নাইপার লেফটেন্যান্ট আবু আ'লা। মসূল তখন প্রায় জনশূণ্য। থেকে থেকে গুলির আওয়াজ আসছে। মাথার উপরে তীব্র শব্দে উড়ে যাচ্ছে ন্যাটোর বিমান।
"এ যুদ্ধ শেষ হলে কি করবে?"
মুখে শুকনো হাসি দিয়ে সে বললো," ইরাকে কখনো যুদ্ধ থামবে না। তবে আমি হয়ত আমার পরিবারের কাছে ফিরে যাব।"
"তোমার পরিবার কোথায় থাকে?" আমি প্রশ্ন করলাম
"আল-কাইয়ারাহতে। এখান থেকে ৬ মাইল দূরের শহর।"
"কে আছে ওখানে?"
"আমার স্ত্রী আর দু'সন্তান।" সতর্ক চোখে সামনে তাকিয়ে আছে সে।
ঠিক এমন সময় বাকিদের চিৎকার শোনা যায়। "আবু আ'লা! আবু আ'লা! সুইসাইড বোম্বার আসছে!"
আবু আ'লার মুখে কোনো পরিবর্তন আসে না। এরকম পরিস্থিতিতেও সে অদ্ভুত শান্তভাবে রাইফেলের স্কোপ ঠিক করে সামনে তাকায়৷ আমি তখন আতংকে কাপছিলাম। আমাদের সাজোয়া বহরের দিকেই একটা নীল রঙের গাড়ি ধেয়ে আসছে। ইরাকে এ ধরনের ভেহিকেল বেইজড ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস, আইএসের প্রিয় অস্ত্রগুলোর একটা। গাড়িভর্তি বিস্ফোরক আর সাধারণ একটা গাড়িতে কিছু আর্মার প্লেট লাগিয়ে ভেতরে একজন সুইসাইড ভেস্টপরা ড্রাইভার নিয়ে এগুলো বানানো হয়। ড্রাইভার হাতে সুইচ চেপে রাখে। সেনাবহরের কাছে এসে সুইচ ছেড়ে দিলেই তীব্র বিস্ফোরণ ঘটে। বহু ইরাকী আর কুর্দি সেনার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই অস্ত্র।
লেফটেন্যান্ট আবু আ'লা জানেন তার হাতে সময় খুব কম। গাড়ির ড্রাইভারের সামনের গ্লাসের সামান্য অংশ খালি, বাকিটুকু ভারি স্টিল দিয়ে মোড়ানো। এই সামান্য অংশের ভেতরই গুলি ফেলতে হবে। একটা দম নিয়ে, ট্রিগারে আংগুল দিয়ে চাপ দেয় সে। সাথে সাথেই তার এম-২৪ স্নাইপার রাইফেল থেকে একটা গুলি বেরিয়ে গাড়ির ড্রাইভারকে আঘাত করে। গাড়িটা আরো সামনে একটু এসে থেমে যায়। আর সাথে সাথেই তীব্র বিস্ফোরণের শব্দে চারপাশ কেপে উঠে। গাড়িটা যেখানে বিস্ফোরণ হয়, তার পাশের ভবনের দেয়াল ধ্বসে পড়ে।
দলের সবাই হাফ ছেড়ে বাচে। সেদিন বিকেলের মধ্যেই মসুলের এই ব্লক মুক্ত হয়ে যায়। রাতে তারা এক বিশাল পরিত্যাক্ত বাড়ির ছাদে ক্যাম্প বসায়৷ দূরে আরেক গ্রুপ সেনার সাথে লড়াইয়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দলের সবাই আগুন জ্বালিয়ে গল্প করছে আর চা খাচ্ছে। কিন্তু আবু আ'লা একটু দূরে বসে তার রাইফেল পরিষ্কার করছে। রাইফেল পরিষ্কার শেষ হতেই সে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। আর আকাশে চাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন যেন শূণ্য দৃষ্টি!
আমি সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। "ও কখনোই আমাদের সাথে যোগ দেয় না।" পেছন থেকে একজন বলে উঠে। তাকিয়ে দেখি, গ্রুপের নেতৃত্বে থাকা একজন ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে আছেন। সৈনিকদের কেউ কেউ তখন গান ধরেছে।
"কেন?" আমি জিজ্ঞেস করলাম
"বড়ই দুঃখের গল্প।" ক্যাপ্টেন জবাব দিলেন
"বলুন তো শুনি।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যাপ্টেন বলা শুরু করলেন," মসুল দখল হবার আগে শিরকাত দখল করে আইএস। আবু আ'লা সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল বেশ ক'বছর আগে। আইএস যোদ্ধারা তাকে তাদের হয়ে লড়াই করার জন্য চাপ দিতে থাকে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, সেখান থেকে পালিয়ে আসবে। একদিন রাতে সে তার দুই ৪ বছর বয়সী যমজ ছেলেকে ঘাড়ে নিয়ে, স্ত্রীসহ বেরিয়ে আসে। কিন্তু পথেই আইএসের এক স্নাইপার তাদের স্পট করে ফেলে। স্নাইপারের গুলিতে তার স্ত্রী প্রাণ হারায়। সে স্ত্রীর মৃতদেহ টেনে বাড়ির বাগানে নিয়ে আসে, নিজে কবর খুড়ে তাকে কবর দেয়। তার দুই ছেলে তখন খুব কাদছিল৷ সে তখন তাদের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আবার তাদের পিঠে নিয়ে আরেক রাস্তা দিয়ে যেতে থাকে। এবারও আইএসের একজন স্নাইপার তাদের স্পট করে। তার ডানকাধে থাকা ছেলেটা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আবার সে বাড়িতে ফিরে আসে। ছেলেকে কবর দিয়ে, আরেক ছেলেকে কোলে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে।"
ক্যাপ্টেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
"তারপর, ক্যাপ্টেন?"
"যখন সে নদী পার হয়ে পালিয়ে আসে, ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। সে তার সন্তানের দিকে তাকায়। আর তারপর নদী তীরে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। আমরা যখন তাকে নিয়ে আসি তখনও সে কথা বলেনি।"
"কেন ওর ছেলেটা মারা গিয়েছিল?"
ক্যাপ্টেন খুব ব্যাথাভরা দৃষ্টি নিয়ে বলে," আসলে অন্ধকারে ও বুঝতে পারেনি। সে ওর জীবিত সন্তানকে মৃত ভেবে কবর দিয়ে আসে আর গুলিতে মৃত সন্তানকে জীবিত ভেবে পিঠে করে নদী পার হয়ে আসে। সেদিন থেকে ও এমন।"
আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলাম। সেদিন আর ঘুমোতে পারিনি। পরদিন সকালে মৃত শহর মসুল ছেড়ে বাগদাদে ফিরে আসি৷ ইরাকে তখন প্রতিদিনই মানুষ মরছে৷ যুদ্ধ এমনই। ডিসেম্বরে আমি ইরাক ছেড়ে যখন দেশে ফিরে আসি, তার কিছুদিন পর এক সহকর্মী ফোন করে জানায়, লেফটেন্যান্ট আবু আ'লা তার পরিবারের কাছে ফিরে গেছে।
You have some nerve mate, you are in Bangladesh and talking about Islam like this! You are a legend, but obviously a dead one