বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার হয় না কেন?
- Just Another Bangladeshi
- Dec 30, 2019
- 4 min read
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে। আমাদের সংবিধানেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক নীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু গত ৪৯ বছরের ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, সে হোক ধর্মীয় কিংবা নৃতাত্ত্বিক; ক্রমাগত হয়রানি, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে।
রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেলে যে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়, সেটি আমরা বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলে দেখেছি। আবার সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীর লোকজন—কেউ পিছিয়ে নেই। অর্পিত সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া ঝুলে থাকে আইনের মারপ্যাঁচে। ‘সংখ্যালঘুবান্ধব’ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে একনাগাড়ে প্রায় সাড়ে ১১ বছর ক্ষমতায় আছে। এই সময়েও যে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হয়রানি বন্ধ হয়নি, তার প্রমাণ রামু, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, সাঁথিয়া, দিনাজপুর এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দুই মাসের বেশি সময় ধরে দেশে অঘোষিত লকডাউন চলছিল। সর্বস্তরের মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিল এবং এখনো আছে। অথচ একশ্রেণির দুর্বৃত্ত এই সংকটকালকেই বেছে নিয়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার সুযোগ হিসেবে।
বিভিন্ন সংবাদপত্র, থানায় দায়ের করা মামলা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সূত্রে জানা গেছে, লকডাউনের সময় দেশের ২৭টি জেলায় অন্তত ৩৬টি হামলা, নির্যাতন, অপহরণ ও উপাসনালয় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব ঘটনার সঙ্গে চিহ্নিত সন্ত্রাসীর পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সম্পৃক্ত থাকারও প্রমাণ মিলেছে। শুধু এপ্রিল মাসে সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি:
১. গত ৪ এপ্রিল সন্ত্রাসীরা সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার নগরঘাটার মুদি ব্যবসায়ী সুবল চক্রবর্তীকে মারধর করে এবং কালেমা না পড়লে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২. গত ২৪ এপ্রিল বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার গোলেডাঙ্গা গ্রামের অনিল বালার পরিবারের ওপর হামলা চালায় পাশের বাঁশতলা গ্রামের একদল ভূমিদস্যু। এতে নারী-শিশুসহ সাতজন গুরুতর আহত হন। থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
৩. রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ঘাসি গ্রামের নিমাই সরকারের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে অষ্টমী সরকারকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন পাশের গ্রামের গোলাম মোস্তফা ও তাঁর সহযোগীরা। গত বছর গোলাম মোস্তফা অষ্টমীকে অপহরণ করলে পুলিশ ওই দিনই তাকে উদ্ধার করে এবং অপহরণকারীকে কারাগারে পাঠায়। এরপর জামিনে বেরিয়ে এসে তিনি আবার অষ্টমীকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। অপমানে মেয়েটি ১৬ এপ্রিল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।
৪. ২১ এপ্রিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার শুক্লাদাস পাড়ায় ৩০টি সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় ও দেশত্যাগের হুমকি দেয়। এতে ১৫ জন আহত হন। এই হামলার পেছনে একজন প্রভাবশালী নেতার ইন্ধন থাকার অভিযোগ আছে।
৫. যশোর জেলার বেনাপোল পৌরসভার ছোট আঁচড়া এলাকার এক সংখ্যালঘু নারী ১৬ এপ্রিল রাতে প্রকৃতির ডাকে ঘরের বাইরে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাবু সরকার তাঁর শ্লীলতাহানি করেন। পুলিশ বাবু সরকারকে আটক করলেও তিনি জামিনে বেরিয়ে এসে আক্রান্ত পরিবারকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
৬. গত ৭ এপ্রিল বিএনপি নেতা মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ১০-১২ ব্যক্তি মাগুরা জেলার মহম্মদপুরে উপজেলার রাধানগর গ্রামের সুমন্ত চক্রবর্তীর পৈতৃক ভিটায় নির্মাণাধীন স্থাপনা হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে গুঁড়িয়ে দেন। সুকান্তের শেষ সম্বল ৬০ শতাংশ জমির ১১ শতাংশ আগেই দখল করে নিয়েছেন মিজানুর। তিনি বিএনপির মহম্মদপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি।
৭. কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার সাতানী হাইল্লা গ্রামের পরিতোষ কুমার সরকারকে ২১ এপ্রিল ইসলাম ধর্ম নিয়ে ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, এই গুজব রটিয়ে মারধর করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকজন। কিন্তু পরিতোষ এ ধরনের কোনো স্ট্যাটাস দেননি। কারা তাঁর ফেসবুকে এসব মন্তব্য করেছে, সেটি খুঁজে বের না করে তাঁকেই আটক করেছে পুলিশ। এই ঘটনা রামু, নাসিরনগর ও ভোলার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রথম আলো।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু পল্লি এবং মন্দিরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০৫ জন গ্রেপ্তার হলেও, তাদের অধিকাংশই ছাড়া পেয়ে গেছে৷ অথচ রসরাজ ফেসবুকে তার মোবাইল ফোন থেকে কোনো পোস্ট দেয়নি – এ কথা প্রমাণ হওয়ার পরও তাকে জামিন দেয়া হওনি তখনও৷ দু৷ তার বিরুদ্ধে পুলিশ তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দিয়েছে, যা কিনা জামিন অযোগ্য৷
একইভাবে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কক্সবাজারের রামু বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনায় ফেসবুক পোস্টের কথা বলে উত্তম বড়ুয়া নামে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক যুবককে আটক করা হয়৷ পরে প্রমাণিত হয় যে সে কোনো পোস্ট দেননি৷ উত্তম বড়ুয়া পরে জামিন পেলেও সে এখন কোথায় আছে, তা কেউ জানে না৷ এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও না৷ অথচ হামলার জন্য যাদের আটক করা হয়েছিল তারা সবাই জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায়ই আছে৷
২০১৩ সালে পাবনার সাথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে ধর্মীয় অবমাননার ভুয়া অভিযোগে অর্ধশত হিন্দু বাড়ীঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
বনগ্রাম বাজারে স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ছেলে রাজীব সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ফেসবুকে ইসলামের কটূক্তি করে পোস্ট দেয়ার। বনগ্রাম হাটের দিনে শত শত লিফলেট বিলিয়ে সাধারণ জনগণকে উত্তেজিত করা হয়।
কিন্তু পরে পুলিশের তদন্তে দেখা যায় রাজীব এরকম কোনো পোস্ট দেয়নি।
অথচ ধর্মীয় অবমাননায় উসকানি পেয়ে সেদিন হাজার হাজার লোকজন সাহাপাড়ায় হামলা করে। এলাকার প্রায় ৩০-৩৫টি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর এবং বাজারে কেন্দ্রীয় কালী মন্দিরসহ বাবলু সাহার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালায়। বাড়ীতে ভাঙচুর করে পারিবারিক মন্দিরে আগুন দেয় আর প্রতিমা ভাঙচুর করে।
বাড়ীতে হামলা, মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আতাইকুলা থানায় মামলা করেছিলেন বাবলু সাহা।
২০১৯ সালে সারা বছর ধরে যে পরিমান নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, ২০২০ সালের প্রথম ৬ মাসেই তার চেয়ে বেশি হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে সারা বছরে হত্যা করা হয়েছিল ১০৮ জনকে, ২০২০ এর ৬ মাসেই হত্যা করা হয়েছে ৭২ জনকে। গত বছর আহত করা হয়েছিল ৪৮৪ জনকে, অথচ এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই আহত করা হয়েছে ৫১২ জনকে। গতবছর বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল ৪৩৪টি পরিবারকে, এবছরের প্রথম ৬ মাসেই বসত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৪৮৯টি পরিবারকে, উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে ১ হাজার ৪৬০ টি পরিবারকে, উচ্ছেদের হুমকি পেয়েছে ১ হাজার ৮০১ পরিবার।
গত বছর দেশত্যাগের হুমকি পেয়েছিল ৬৪১টি পরিবার। এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই তা তিন গুন বেড়ে উচ্ছেদের হুমকি পেয়েছে ১ হাজার ৮০১ পরিবার। গত বছর দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিলো ৩৭৮টি পরিবারকে, এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ৫৪৫টি পরিবারকে। গতবছর নিরাপত্তাহীনতায় ছিল ২ হাজার ২৬১ পরিবার, এবছর প্রথম ৬ মাসেই ৩ হাজার ৮০৬টি পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গত বছর মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল ১৫৩টি, এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই এমন ঘটনা ঘটেছে ১৬৪টি। বাড়িতে হামলা ভাংচুর অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিলো ৪৪৮টি, এবছর তা বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৪৩৭টি। ভোরের কাগজ যেখানে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত, সেখানে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুনির্বিশেষে অন্যায়ের প্রতিকার পায়। কিন্তু যেখানে আইনের শাসন নড়বড়ে এবং বাছাইকৃত, সেখানে সংখ্যালঘু ও অপেক্ষাকৃত সমাজের দুর্বল শ্রেণির ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাটি সকাল-বিকেল মুখে আওড়ালেই হয় না, অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে সেটি কাজেও প্রমাণ করতে হবে। দু-একটি স্থানে সংখ্যালঘুদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর বা মন্দির পুনর্নির্মাণ করলেও তারা নিরাপদ বোধ করবে না যতক্ষণ না অপরাধের বিচার হয়।
তথ্য সূত্র প্রথম আলো, বিবিসি বাংলা, ভোরের কাগজ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও DW বাংলা।
ধন্যবাদ দাদা পোস্টটি শেয়ার করার জন্য
পোস্টটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম
সত্যি ঘটনা গুলো তুলে ধরার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
উপস্থাপনা খুব সুন্দর হয়েছে
পরবর্তী পোস্টের অপেক্ষায় রইলাম