ভাই মারামারি করেন না?
কবিরের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। কবির দেখতে শুনতে নায়কের মত না হলেও পার্শ্বচরিত্রের হ্যান্ডসাম ছেলেদের কাছাকাছি। ভালো বেতনের চাকরি করছে, বাবার জমির উপরে দুই তলা বাসাও উঠিয়েছে নিজের টাকায়। মাসখানেক হলো শখের বাইকটাও কিনেছে। ছেলে হিসেবে কবির ফেরেশতা লেভেলের কাছাকাছি মানুষ।
কিন্তু সমস্যা একটা আছে। পৃথিবীতে কেউ নিখুঁত হয়ে আসে না। নয় কোনও না কোনও একটা সমস্যা নিয়ে জন্মায়, না হয় জন্মানোর পর সমস্যা তৈরি করে। কবিরের বেলায় সমস্যাটা দুই জায়গাতেই। তার সমস্যা, সে জন্ম নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
মাসখানেক আগের কথা। মেয়ে দেখে এসেছে কবিরের পরিবার। মেয়ে কবিরের মায়ের পছন্দ হয়েছে। বাসায় এসে কবিরের মা কবিরকে জড়িয়ে ধরে হুদাই কান্না করতে লাগলেন। কবির তার মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলো, ছেলেপক্ষ যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোক, তা মেয়েপক্ষ জানে কি না। কবিরের মা বলেছিলেন, না, এখনও জানানো হয় নি। কবির মায়ের চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেছিলো, ' ফাউ কাইন্দো না। ফোন দিয়া কও আমরা ক্যাডা। '
কবিরের বাবা মেয়ের বাবাকে ফোন দিলেন। কবিরের অনুরোধে ফোন লাউডস্পিকারে রাখা হলো।
' হ্যালো বিয়াইন সাহেব, কি খবর? '
' কোনও খবর নাই আসলে, এমনেই ফোন দিলাম। আমরা সহীহ সালামতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছায় গেছি। আপনারা টেনশন করবেন না হুদাই। '
' ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেন গিয়েছেন? ওদিকে অবস্থা ভালো না, দ্রুত বাসায় চলে যাইয়েন। '
' বিয়াইন সাব, আমাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। '
' ও। '
বিয়াইন সাহেবের 'ও' শুনে কবিরের মায়ের হাত থেকে ঔষধের বাটি নিচে পড়ে গেলো। কবিরের বাবা লাউডস্পিকার অফ করে দিয়ে কথা বলতে লাগলেন, দশ মিনিট কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে বললেন, নাক্কির পুতেরে ট্যাটা দিয়া পাড় মারতে মন চাইতাছে।
এইটা মেয়ে দেখার একটা নমুনা। কবিরের অনলাইনের জীবন আরও করুণ। অচেনা অজানা লোক ম্যাসেজ দেয়। একদিন এক লোক কবিরকে ম্যাসেজ দিয়ে কবিরের কুশলাদি জানতে চাইলো। কবির সামান্য কথা এগুতেই লোক তার মশকরা শুরু করে দিলো।
' ভাই মারামারি করেন না? '
' মারামারি করবো কেন? এইটা কি মৌলিক চাহিদা নাকি যে করা লাগবে? '
' হায় হায় ভাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকেন অথচ মারামারি করেন না? এই মিয়া সত্যি করে বলেন তো আপনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ কি না? '
' আজব তো! '
কেউ ম্যাসেজ দিয়ে বলে, ভাই বর্ষাকাল চলে আসছে, কুরিয়ারে ট্যাঁটা পাঠাতে পারবো কি না। কবির লিখে, ট্যাঁটা তোর পিছনে ভরে ঘুটলান দিবো। তারপর সেইটা কেটে লিখে, ফাইজলামির একটা সীমা আছে। ওই লোক ইমো পাঠায়। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যাওয়ার ইমো। কবির তাকে ব্লক দেয়। কিন্তু কয়জনকে ব্লক দিবে?
আচ্ছা, টপিক বদলে গেছে। কবিরের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। তাকে দ্রুত একটা বিয়ে করানো দরকার বলে মনে করেন কবিরের বাবা মা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ের সাথে বিয়ে দিবে না, কারন একই এলাকার দুই পরিবার এক হলে, ভবিষ্যতে মারামারি লাগলে চোখের পলকে মেয়েপক্ষ ট্যাঁটা লাঠি পাটকেল নিয়ে মাঠে চলে আসবে। যত দূর থেকে মেয়ে আনা যায় তত ভালো।
প্রথমবার মেয়ে দেখতে কবিরকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লোকাল সেলুনে গোল্ড ফেসিয়াল করে কবিরকে একদম গুজরাটি সিনেমার নায়ক মনে হচ্ছে। এই ছেলের দিকে তাকিয়ে কেও না বলতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা, এই পরিবার জানে তারা কোথাকার লোক। এদের কোনও সমস্যা নেই, ছেলে দেখলে সমস্যা আরও থাকবে না।
মেয়ে দেখে কবিরের মা কবিরের কানে কানে বললো, ' মেয়ে দেখি ট্যারা! ফাক! '
' আম্মা এই শব্দ তুমি কই শুনলা? এইটার মানে জানো? '
' তুই কি আমারে মূর্খ ভাবস? মানুষ আছে আশেপাশে, না হইলে তোরে চটকাইতাম। '
' এই শব্দ আর ব্যবহার করবা না। চুপচাপ বসো। '
কবির মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো, বিশাল ঘোমটা দিয়ে মেয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। এই মেয়ে ট্যারা সেইটা বুঝার কোনও উপায় নাই। কবিরের মা কিভাবে বুঝলো এই মেয়ে ট্যারা? কবির মনে মনে বিরক্ত।
অনেককিছু রান্না করা হয়েছে, কবিরের পরিবারসহ কবিরকে বসিয়ে দেয়া হলো। মেয়ে ঘোমটা না সরিয়েই খাবার পরিবেশন করছে। কবিরের বাবা কবিরকে বললেন, ' মেয়ে ট্যারা হইলেও আদব কায়দা জানে। মাশাল্লাহ। '
' মেয়ে ট্যারা সেইটা তুমি কিভাবে বুঝলা? আমি তো দেখলাম না! '
কবিরের বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' মেয়ে এতো বড় ঘোমটা দিসে, আমার ছেলে মেয়েকে দেখতেই পায় নাই। লজ্জায় বলতেও পারতেছে না। মা, ঘোমটা টা সরাও তো একটু। '
কবিরের ইচ্ছা হলো মাটি খুঁড়ে নিচে চলে যেতে। কি অবান্তর কাজকর্ম! কবির লজ্জায় মুখের ভিতরের মাংস চিবুতে ভুলে গেলো।
মেয়ে ঘোমটা সরালো। মেয়ে আসলেই ট্যারা। নাকের উপর বড়সড় একটা আঁচিল আছে। কবির মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো, আহারে, একটু ট্যারা আর নাকের আঁচিলের জন্য হয়তো কেউ মেয়েটাকে পছন্দ করেনি আগে। সমস্যা নেই। এই মেয়েকে সে বিয়ের পর অনেক ভালোবাসবে।
কবিরের হরমোনজনিত কল্পনায় বাঁধ সাধলেন মেয়ের মা। ' ওই তুই ক্যাডা??? ' বলে তিনি মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। মেয়ের ভাই, ভাবী, চাচারা তাকে ধরলেন। মেয়ের বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে, তিনিও বললেন, ' এইডা কে? ওই হাফিজ এইডা কে? '
হাফিজ মেয়ের বড় ভাই। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ' এইটা তো তনুশ্রী, মিতালির বান্ধবী! '
কবিরের বাবা পোলাও চিপে দলা পাকিয়ে ফেলেছেন। রাগে তার চোখ লাল হয়ে গেছে। কবিরের মা বললেন, ' ভেরী ব্যাড। আমরা ফাক হয়েছি। আপনারা এমনটা আমাদের সাথে করতে পারলেন? স্যাড। '
কবির সত্যি সত্যি পায়ের পাতা দিয়ে টেবিলের নিচে ঘসতে লাগলো। যদি একটা গর্ত পাওয়া যায়, যদি সেই গর্তে ঢুকে পড়া যায়...
' মিতালি এইটা আপনাকে দিতে বলেছে। '
কবিরের হাতে একটা কাগজের টুকরা ধরিয়ে দিয়ে তনুশ্রী নামের মেয়েটা দৌড়ে বের হয়ে গেলো। কবির দেখলো, মেয়েটা একদমই ট্যারা না। কাছ থেকে দেখলে বুঝা যায় আঁচিলটা নকল। দৌড়ে বের হওয়ার সময় তনুশ্রীর পরচুলা খুলে পড়ে গেলো। কবির দেখলো, তনুশ্রীর মাথায় ছেলেমানুষের মত ছোট ছোট চুল।
কাগজের টুকরোটা মিতালির চিঠি টাইপ চিরকুট টাইপ হাইব্রিড। মানুষ চিঠি অনেক গুছিয়ে, সময় নিয়ে, সুন্দর করে বড় করে লিখে। চিরকুট লিখে তাড়াহুড়ায়। এইটা বড় করে লেখা হয়েছে, তবে লেখার মান দেখে মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ায় লেখা জিনিস।
' আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব না। আপনারা কষ্ট পাবেন না। একটা উপদেশ দেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কম বড় এলাকা না। বিয়ে করার মত অনেক মেয়ে পাবেন সেখানে। ঢাকায় এসে শুধু শুধু সময় নষ্ট করবেন না।
ভালো থাকবেন। মারামারি করবেন না। জীবনে মারামারি ছাড়াও অনেক কিছু আছে। সেইটা বুঝতে পারলেই দেখবেন অনেককিছু বদলে গেছে।
বিঃ দ্রঃ আমার বান্ধবী তনুশ্রীর উপর আবার ফিদা হবেন না প্লিজ। ও ছেলেমানুষ এর চেয়ে মেয়েমানুষের প্রতি বেশী দুর্বল। '
কবিরের মনে হলো, বিঃ দ্রঃ টুকু লেখার কোনও প্রয়োজন ছিলো না। একভাবে ভাবলে, পুরো জিনিসটাই লেখার প্রয়োজন ছিলো না। এই উপদেশ কার জন্য? সে তো মারামারি করে না। ট্যাঁটাযুদ্ধের সৈনিক তো সে না! তাহলে এসবের দায় সে কেন বহন করবে বাল?
কবির গাড়িতে উঠতে উঠতে খেয়াল করলো, তাদের বিদায় দিচ্ছে বাড়ির মহিলারা। মেয়ের বাবা ও বড় ভাই ভয়ে পালিয়েছে। ভাড়া করা ড্রাইভার হাসতে হাসতে এসে কবিরের বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ' চাচা, আপনারা তো খাইয়া আসলেন, আমি এখনও খাই নাই। '
কবিরের বাবা ড্রাইভারকে প্রচন্ড জোরে চড় মারলেন, আর চিৎকার করে বললেন, ' নাক্কির পুত! ' তার চিৎকার শুনে বিদায় দিতে আসা মহিলারা আল্লাগো বলে চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাতে লাগলো। কবিরের মা বললেন, ' ফাক, সবাই পলাইতেছে কেন? '
গাড়ি ছুটলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে। রাস্তায় কবির জানতে পারলো, তার মা জানে ' ফাক ' এর মানে হচ্ছে ' আশ্চর্য হওয়া '। এই গাঁজাখুরি ইংরেজি তাকে ফেসবুকের এক মেয়ে শিখিয়েছে। কবিরের মা যে অনলাইনে এইসব মশকরার স্বীকার, তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কবিরের মা অনলাইনে। কবির ফ্রন্ট সিটে জানালার কাঁচ নামিয়ে বসে আছে। বাইরের বিল্ডিংগুলো একে একে তাদের পিছনে চলে যাচ্ছে। তনুশ্রীকে মনে পড়ছে। তনুশ্রী বলেছিলো, মিতালি এইটা আপনাকে দিতে বলেছে। কি মিষ্টি কন্ঠ। কবির গাড়িতে বসা তার বাবা মা ও চড় খেয়ে লাল হয়ে যাওয়া ড্রাইভারকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে বললো, ফাক! কবিরের বাবা বললেন, আসলেই। এরকম আশ্চর্য কামকারবার আমার বাপের জন্মে দেখি নাই।
Commentaires