সীতা হওয়ার মূল্য কি (part 1)
আজকাল ভারত রামরাজ্যের দাবীতে ভরে উঠেছে। বিশ্বাসীর চোখে রামরাজ্য ন্যায়-শান্তির রাজত্ব।রাম তাদের কাছে কাছে ভগবান। অন্ধভক্ত অবিবেচকের মত আজকের যুগে এসেও রামরাজ্য হয়তো চাইতে পারে কিন্তু রামায়ণ পড়া কোনো নারীর পক্ষে রামের রাজত্ব চাওয়া সম্ভব নয়! রামরাজ্যের নাম শুনলেই তার আঁতকে ওঠার কথা। অন্তত অবতার শ্রী রামচন্দ্র তার স্ত্রী সীতার সাথে কি রকম আচরণ করেছিলেন সেটা জানার পর, সে রামরাজ্য চাইবে না নিশ্চিত। রামের ন্যায় স্বামীও যে চাইবে না এই বিষয়েও তেমন সন্দেহ নেই।
যাইহোক রামায়ণের ঘটনা শুরু করা যাক।
জনকের কন্যা সীতাকে হরধনু ভঙ্গ করে স্বয়ম্বর সভা থেকে বিবাহ করে এনেছিলেন রাম। তার সাথে বেশ কিছু দিন সংসারও করেছেন।একদিন তার রাজ্যাভিষেকের সময়ে বিমাতা কৈকেয়ী তার পুত্র ভরতকে রাজা করার জন্য দশরথকে কৈকেয়ীকে দেওয়া পূর্বের বরের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। রামচন্দ্র কামুক পিতা দশরথের প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য ১৪ বছরের বনবাসে গমন করেন। এই দুঃসময়ে সীতা রামের সঙ্গ দেন, স্বামীর সাথে একসাথে বনে গমন করেন।📷
বনবাসকালীন সময়ে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়ে বসেন রাম-লক্ষ্মণ দুইভাই।রামকে লঙ্কার রাজা রাবণের নিজ বোন শূর্পণখার ভালো লাগলে, সে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে রামের কাছে উপস্থিত হয়। রাম তাকে প্রত্যাখ্যান করে তার ভাই লক্ষ্মণের কাছে তাকে প্রেরণ করে।রাম -লক্ষ্মণ এক স্ত্রীর ভাবাবেগ নিয়ে এভাবে খেলার পর, অকারণে তার নাক,কান কেটে রক্তাক্ত করে অনার্য জাতির প্রতি তাদের মনের অন্তর্নিহিত জ্বালা মেটায়। (বাল্মীকিতে বলা আছে, শূর্পনখা নাকি এক পর্যায়ে রাম-লক্ষ্মণদের খাওয়ার জন্য আক্রমণ করেছিল, কিন্তু অনার্যদের প্রতি বিতৃষ্ণা বশত,তাদের যে রাক্ষস প্রতিপন্ন করার একটা প্রবণতা আর্যদের ছিল, তা তাদের সাহিত্য পাঠে সহজেই বোঝা যায়।)
বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে লঙ্কার রাজা রাবণ একসময় সীতাকে অপহরণ করে। সীতাকে বিবাহের শত প্রস্তাব দেওয়া সত্ত্বেও,সীতা রামের নাম স্মরণ করেই রামের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
একসময় দলবল নিয়ে রাবনকে হত্যা করে সীতাকে উদ্ধার করেন রাম।
হিন্দুদের মধ্যে সতীত্বের জন্য সাবিত্রী-সীতারা বেশ জনপ্রিয়। লোকসমাজে তাদের মত হতেই নারীদের শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু এই সতীত্ব অথবা পতিব্রাত্যের প্রকৃত মূল্য কি তা সীতাকে না দেখলে বোঝা যায় না।
সীতার অগ্নিপরীক্ষা
রাবণ বধের পরে সীতা ও রাম মুখোমুখি হন।সীতাকে দর্শনমাত্র রাম বলেন,
“ভদ্রে! আমি রণস্থলে শত্রু জয় করিয়া তোমাকে উদ্ধার করিলাম, পৌরুষবলে যাহা করিতে হয়,তাহা সমস্তই করিলাম। ক্রোধের পার প্রাপ্ত হইয়াছি; তোমার অবমাননা জন্য কলঙ্ক মোচন করিলাম।আজ আমার পৌরুষ দেখান হইল। আজ আমার শ্রম সফল হইল।আজ আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হইল, আজ আমি স্বাধীন। আমি অনুপস্থিত থাকায় চলচিত্ত রাক্ষস তোমায় হরণ করিয়াছিল, সে দৈবকৃত দোষ,আমি মানুষ হইয়া দৈবকৃত দোষ দূর করিলাম। যে ব্যক্তি অবমানিত হইয়া সেই অপমান স্খলন না করে সেই লঘুচিত্ত ব্যক্তির পুরুষাকারে কি প্রয়োজন? হনুমান সমুদ্র লঙ্ঘন এবং লঙ্কা দহনাদি যে সকল শ্লাঘনীয় কার্য করিয়াছিল আজ তাহা সার্থক হইল। সসৈন্য সুগ্রীব যে হিতজনক মন্ত্রণা প্রদান এবং যুদ্ধে পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছিলেন আজ তাহার সেই শ্রম সফল হইল।”
“তোমার ধর্ষণা স্খালন করিবার জন্য মনুষ্যের যাহা কর্তব্য আমি নিজের মান রক্ষার জন্য রাবণকে বধ করিয়া তাহা করিয়াছি। ঋষি শ্রেষ্ঠ অগস্ত্য যেরূপ দুর্জয় দক্ষিণদিক জয় করিয়াছিলেন, সেইরূপ আমিও রাবণের সহিত যুদ্ধ করিয়া তোমাকে জয় করিয়াছি।ভদ্রে! তুমি জানিও আমি সুহৃদ গণের বীর্য বলে যে দারুণ রণপরিশ্রম করিয়াছি , ইহা তোমার কারণ নহে। তোমার হরণ জনিত অপবাদ অপনয়ন এবং বিখ্যাত বংশের মর্যাদা রক্ষা করিবার জন্যই আমি এইরূপ কার্য করিয়াছি।
রামের কথায় স্পষ্ট হয়, রাবণ রামের কোনো সম্পদ নিয়ে গিয়েছিল, যার ফলে তার পৌরুষ আহত হয়, তাই রাম কেবল তার পৌরুষ প্রদর্শনের জন্যই রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার জন্য যে তিনি রাবণের সাথে যুদ্ধ করেছেন সেরূপ নয়! রাম কেবলই নিজের মান রক্ষার জন্য সীতাকে জয় করেন। তাই সীতাকে রাম পরিষ্কার করেই জানিয়ে দেন,
“ভদ্রে! তুমি জানিও আমি সুহৃদ গণের বীর্য বলে যে দারুণ রণপরিশ্রম করিয়াছি , ইহা তোমার কারণ নহে।”
রাম কেবলই তার অপবাদ মোচনের জন্য সম্পদরূপ সীতাকে জয় করেন,’ঋষি শ্রেষ্ঠ অগস্ত্য যেরূপ দুর্জয় দক্ষিণদিক জয় করিয়াছিলেন’,সেইরূপ।
আমার জানা মতে, সীতা উদ্ধারের আরেকটি কারণ রাম সীতার কাছে প্রকাশ করেননি, সেটি হল- রামের কামুকতা। সীতাকে রাবণ হরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর রাম অত্যন্ত বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তার বিষাদের প্রকৃত কারণ প্রেম নয় খুব সম্ভবত (কেননা, সীতার প্রতি রামের প্রেম কিরূপ এখানে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি), কামাতুর হয়েই রাম সীতার জন্য অনেক বিলাপ করেছেন, আর এই কামের তাড়নাই খুব সম্ভবত তাকে সীতা উদ্ধারে প্রেরণা জুগিয়েছে।
হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত বাল্মীকি রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকান্ডের ত্রিংশ সর্গে দেখা যায়-
“এদিকে রাম একান্ত কামার্ত; শরতের পাণ্ডুবর্ণ আকাশ,নির্মল চন্দ্রমন্ডল ও জ্যোৎস্নাধবল রজনী দর্শন করিলেন;সুগ্রীবের সুখভোগে আসক্তি এবং জানকীর অনদ্দেশের কথা চিন্তা করিলেন,বুঝিলেন,সৈন্যের উদযোগকাল অতীত হইয়াছে।তিনি যারপারনাই কাতর হইয়া মোহিত হইলেন এবং ক্ষণবিলম্বে সংজ্ঞালাভ করিয়া হৃদয়বাসিনী সীতাকে ভাবিতে লাগিলেন।…………”
তাই রামের কাম কেটে গেলে রাম তার মূল চরিত্রে ফিরে আসেন। রাম বলেন,
সীতে! তোমার চরিত্রে আমার সন্দেহ জন্মিয়াছে, অতএব তুমি আমার সম্মুখে থাকিয়া নেত্ররোগগ্রস্থ ব্যক্তির সম্মুখস্থিত দীপশিখার ন্যায় আমাকে যারপারনাই কষ্ট দিতেছ। অতএব ভদ্রে! জনকাত্মজে! এই যে দশদিক দেখিতেছ, ইহার যে দিকে ইচ্ছা হয় তুমি যাও; তোমাতে আর আমার কোনো প্রয়োজন নাই।
সীতা অপহৃতা হওয়াতে রাম সীতার চরিত্রেই দোষারোপ করলেন, সীতা যদি রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা হতেন তবে রামের কিরকম প্রতিক্রিয়া হত তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমান সমাজেও কিছু নিম্নশ্রেণীর লোক দেখতে পাবেন, যৌন নিপীড়ন অথবা ধর্ষণের পর তারা অত্যাচারীতাকেই দোষারোপ করতে থাকে; তার পরনে পর্যাপ্ত পোশাক ছিল কিনা (কতটা হলে যে পর্যাপ্ত তা তারাই জানবে, ঘোমটা দেওয়া,বোরখা পরা মহিলারাও তো রেহাই পান না অনেক সময়েই তাদের হাত থেকে) তা নিয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়ে। কাপড়েও যদি ত্রুটি খুঁজে না পায় তখন তারা তার চরিত্র,অসময়ে ঘরের বাইরে বেরোনো ইত্যাদি একের পর এক ছিদ্র অন্বেষণ করতেই থাকে, কিন্তু ধর্ষক অথবা নিপীড়কের প্রতি তাদের কিঞ্চিত আক্রোশও প্রকাশিত হয় না। এসব হয়তো তারা তাদের অবতার রামচন্দ্রের কাছ থেকেই শিখে থাকবেন!
সীতার চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রামচন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। রামচন্দ্র বলেন,
যে স্ত্রী বহুকাল পরগৃহে বাস করিয়াছে, কোন সদ্বংশজাত তেজস্বীপুরুষ, সুহৃদবোধে সেই স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করিতে পারে? রাবণ কুদৃষ্টিতে তোমাকে দেখিয়াছে, ক্রোড়ে করিয়াছে, সুতরাং আমি তোমাকে পুনরায় গ্রহণ করিয়া আমার সমহান কুল কলঙ্কিত করিতে পারি না। যে কারণ তোমাকে উদ্ধার করিয়াছি আমার সেই উদ্দেশ্য সফল হইয়াছে, সুতরাং তোমাতে আর আমার প্রয়োজন নাই, যথায় ইচ্ছা চলিয়া যাও।
এমনকি সীতাকে বিদ্রুপ করে রাম বলেন,
ভদ্রে সীতে! আমি বিবেচনা পূর্বক যাহা বলিবার তাহা বলিলাম, এক্ষণে লক্ষণ, ভরত বা শত্রুঘ্নের নিকটে থাকিতে তোমার ইচ্ছা হয় তাই কর, অথবা সুগ্রীব কিংবা বিভীষণকেও আত্মসমর্পণ করিতে পার। তুমি অনেকদিন রাবণের ঘরে বাস করিয়াছিলে অতএব সে তোমার লোকাতীত মনোহর রূপ দেখিয়া তোমাকে যে ক্ষমা করিয়াছে এরূপ বোধ হয় না।”
রামের এরূপ কথা শুনে জানকি কাঁদতে থাকেন।সীতা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
” বীর! ভদ্রেতর ব্যক্তি আর্যেতরা মহিলাকে যেরূপ বলিয়া থাকে, সেরূপ আপনি আমাকে নিদারুণ কথা শুনাইতেছেন কেন? মহাবাহো! আপনি আমাকে যেরূপ মনে করিতেছেন আমি সেরূপ নহি।আমি আমার চরিত্রের দিব্য করিয়া বলিতেছি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন।আর্যেতরা সাধারণ রমণীর চরিত্র দেখিয়া আপনি স্ত্রীজাতির ওপরে আশঙ্কা করিতেছেন,কিন্তু আপনি আমাকে অনেকবার পরীক্ষা করিয়াছেন সুতরাং এ আশঙ্কা দূর করুন।”
সীতা বলেন,
প্রভো! আমি আত্মবশে না থাকায় রাবণের সহিত আমার যে শরীর সংস্পর্শ ঘটিয়াছিল, তাহা আমার ইচ্ছাকৃত নহে, দৈবই সেই বিষয়ে অপরাধী …… গাত্রসকল আমার বশীভূত নহে। অতএব রক্ষক না থাকায় রাবণ তা স্পর্শ করিয়াছে, তাহাতে আমার অপরাধ কি?
সীতার একটি বাক্য খুবই মর্মস্পর্শী বলে মনে হয়েছে আমার,
নাথ যাহা আমার অধীন সেই হৃদয়কে তো কেহ স্পর্শ করিতে পারেন নাই।
রামের হৃদয় থাকলে তবেই তো তিনি বুঝতে পারতেন,সীতার অন্তরকে রাবণ স্পর্শ করতে পারেনি। যার অন্তর নেই, তিনি কি করে বুঝবেন, সীতা!
সীতা অসহায়ের মতো বলে গিয়েছে,
“হায়! বহুকাল একত্রিত থাকিয়া আমাদের অনুরাগ এককালে সংবর্ধিত হইয়াছিল। কিন্তু আপনি যে তাহাতেও আমার চরিত্র অবগত হইতে পারেন নাই। আমি তাহাতেই অপার দুঃখে পরিলাম। রাজ শার্দুল! আপনি ক্রোধান্বিত হইয়া সাধারণের ন্যায় ,আমার কেবল স্ত্রীত্বই বিবেচনা করিলেন।আমি রাজর্ষি জনকের যজ্ঞভূমি হইতে উৎপন্ন বলিয়াই লোকে আমাকে জানকী বলিয়া থাকে,প্রকৃত পক্ষে জনকের ঔরসজাতা নহী, পৃথিবীর গর্ভে আমার জন্ম। ক্রিতজ্ঞ!আপনি আমার চরিত্র সম্বন্ধে সমুচিত সম্মাননা করিলেন না; বাল্যকালে শাস্ত্রানুসারে, আমার পাণিগ্রহণ করিয়াছেন, তাহাও আপনি দেখিলেন না, আপনার প্রতি আমার ভক্তি এবং আমার কিরূপ স্বভাব তাহাও বিবেচনা করিলেন না ।”
সীতা আক্ষেপের সাথে প্রশ্ন করে, সীতার চরিত্র সম্বন্ধে রামের যদি সন্দেহ জন্মে থাকে তবে কেন তিনি লঙ্কাতেই সীতাকে ত্যাগ করলেন না, কেন বৃথা পরিশ্রম করে ভয়ানক যুদ্ধ করলেন?-
বীর আপনি যখন বীরবর হনুমানকে লঙ্কা মধ্যে আমাকে দেখিতে পাঠাইয়াছিলেন তখন কেন পরিত্যাগ করেন নাই? হনুমান আমাকে আপনার সেই পরিত্যাগ সংবাদ শুনাইলেই আমি সে দণ্ডে ইহার সম্মুখেই প্রাণত্যাগ করিতাম। রাঘব! তাহা হইলে আপনাকে এরূপ প্রাণসংশয় স্বীকার পূর্বক অকারণে সুহৃদ বর্গকে কষ্ট দিয়া এরূপ যুদ্ধ শ্রম করিতে হইত না।
বেচারী সীতা কি তখনো বুঝতে পারেননি, রাম তাকে ভালোবাসেন না, তিনি রামের কাছে কেবলই সম্পত্তি যা আরেকজন চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় রামের আত্মসম্ভ্রম আহত হয়, তার ফলেই তিনি যুদ্ধ যাত্রা করেন!
তারপর বিষন্ন সীতা লক্ষ্মণকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
”সৌমিত্রে এরূপ মিথ্যা অপবাদগ্রস্থ হইয়া আমি আর প্রাণধারণ করিতে ইচ্ছা করি না। এক্ষণে চিতাই এই ঘোরতর বিপদের একমাত্র ঔষধ, অতএব তুমি চিতা প্রস্তুত করো। স্বামী আমার গুণে অসন্তুষ্ট হইয়া জনসমূহের মধ্যে আমাকে পরিত্যাগ করিলেন সুতরাং আমি এক্ষণে অগ্নিতে প্রবেশ করিয়া আমার কর্মানুরূপ গতি লাভ করি।”
সীতার কথা শুনে লক্ষণ ক্রোধভরা দৃৃষ্টিতে রামের দিকে তাকান,কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে রামের মনের ভাব জানতে পেরে লক্ষ্মণ চিতা প্রস্তুত করেন। চিতা প্রস্তুত হলে রাম মুখ নিচু করে বসে থাকেন। রামকে প্রদক্ষিণ করে সীতা অগ্নিকে বলেন-
📷
“যখন আমার মন কখনো রাম হইতে বিচলিত হয় নাই, তখন লোকসাক্ষী সর্ব শুচি অবশ্যই আমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করিবেন। আমার চরিত্র বিশুদ্ধ হইলেও স্বামী যেরূপে আমাকে দুষ্টা মনে করিতেছেন, সেইরূপ সকল লোকের পাপ পূণ্যের সাক্ষী ভগবান পাবক আমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করুন। আমি কায়, মন ও বাক্যে কখনও ধর্মজ্ঞ রঘুনন্দনকে অতিক্রম করি নাই, সুতরাং বিভাবসু আমাকে রক্ষা করুন।“
এই বলে সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করলেন।
সীতা আগ্নিতে প্রবেশ করলে, অগ্নিদেব জানকিকে কোলে নিয়ে উঠে আসেন। পরে লোকসাক্ষী অগ্নিদেব সীতাকে রামের নিকট দিয়ে বলেন,
” রাম এই তোমার বৈদেহীকে (সীতাকে) গ্রহণ কর। ইহাতে পাপের লেশমাত্র নাই। চরিত্র গরবিন, এই শুভলক্ষণা সচ্চরিত্রা সীতা, বাক্য মন , বুদ্ধি,অথবা চক্ষু দ্বারাও কখন তোমাকে অতিক্রম করেন নাই। যখন ইনি নির্জন কাননে একাকিনী ছিলেন , সেই সময় তোমার অনুপস্থিতি বশতঃ বীর্যোন্মত্ত রাক্ষস রাবণ বলপূর্বক ইহাকে হরণ করিয়া, তাহার অন্তপুরে অবরুদ্ধ করিয়াছিল। তথায় ঘোরবুদ্ধি ঘোররূপ রাক্ষসী গণ বারবার প্ররোচিতা এবং প্রলোভিতা করিলেও, একমাত্র তোমাতেই অনুরক্তা জানকী ক্ষণমাত্রও রাবণকে চিন্তা করেন নাই। তিনি নিরন্তর এক মনে তোমাকেই ধারণ করিতেন। রাঘব! আমি আদেশ করিতেছি এই পাপহীনা বিশুদ্ধস্বভাবা সীতাকে গ্রহণ কর। ইহাকে আর কোনো কথা বলিও না।”
তারপর রাম অগ্নিকে বলেন,
“জানকি যে লোকসকলের মধ্যে সমাধিক পবিত্রা, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ইনি রাবণের অন্তঃপুরে বহুকাল বাস করিয়াছিলেন, সুতরাং আমি যদি বিশুদ্ধরূপে পরীক্ষা না করিয়াই ইহাকে লইতাম, তাহা হইলে লোকে বলিত যে, ‘দশরথ পুত্র রাম নিতান্ত কামপরতন্ত্র এবং সাংসারিক ব্যবহারে একান্ত অনভিজ্ঞ।‘
রাম যদি অবতার হয়ে থাকেন, তবে তার কি লোককে সঠিক পথ দেখানো উচিত ছিল না? নাকি রক্ষণশীল, গোঁড়া লোকেদের দেখানো পথে তার চলা উচিত ছিল? রাম যদি আগেই জেনে থাকেন, সীতা সচ্চরিত্রা তবে তাকে সকলের সামনে হেনস্থা করে রাম সবাইকে কি শিক্ষা দিয়ে গেলেন? আর তার অপহৃতা পত্নীকে ফিরে পাওয়ার চাইতে তার কাছে তার তথাকথিত সতীত্ব বড় হল? রাম যে সীতাকে একদমই ভালোবাসতেন না, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
যাইহোক,এর পরে রাম সীতাকে গ্রহণ করেন।
সীতার অগ্নিপরীক্ষা অথবা অগ্নিতে প্রবেশ আক্ষরিক অর্থে সত্যি হতে পারে না,কারণ বাস্তবে অগ্নিদেব কখনো কাউকে কোলে নিয়ে উঠে আসেন না। এটা নিশ্চয় কবির রূপকময় ও অলঙ্কারময় বর্ণনা । তবে সীতাকে খুব সম্ভবত তৎকালীন কোনো ডাক্তারী পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়ে নিজের সতীত্বের প্রমাণ দিতে হয়েছিল।
সীতার সতীত্ব পরীক্ষাতেই সম্পূর্ণ গল্প শেষ হয়ে যায় না…
Comments