সামাজিক উপন্যাস
সবুর মিয়া থানা থেকে বিশাল সুখবর নিয়ে এসেছে।এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এলাকায় শান্তি কমিটি করতে হবে।সবুর মিয়া তার ইউনিয়েনের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছে। হোসেন আলী মাতুব্বর,আইয়ুব মিয়া,কাশেম সুদী,গদু মেম্বার,সোনা খাঁ,করিম মুন্সী,কালা মাতুব্বরসহ সবুর মিয়ার লোকজন সবাই কমিটির সন্মানিত সদস্য হতে পেরে দারুন খুশি।তাদের বাড়ির তরুণদের নিয়ে একটি রাজাকার বাহিনীও গঠন করা হয়েছে।প্রতিদিন সকালে বিকেলে আর্মিরা তাদেরকে অস্র চালনার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে।রাতে তারা চারদলে ভাগ হয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্য,তাদের অভিভাবকদের ধরতে অভিযানে নামে। এলাকার যেসব তরুণ মুক্তিযুদ্ধে চলে চলে গেছে তাদের বাপ মাকে বাড়িতে পেয়ে ইচ্ছামত পেটায় তারা।
কালামের বাপ চাচারা আগেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।কালামকে না পেয়ে তাদের বিশাল বাড়িটি পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় খান সেনারা।আজহার প্রিন্সিপ্যালদের বাড়ি পোড়াতে গেলে সবুর মিয়া বড় অফিসারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কোনমতে রক্ষা করে।যারা মুক্তিবাহিনীতে চলে গেছে তাদের সবার বাড়িগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় রাজাকার -পাকসেনারা। সোনা পাড়ার রহিম খালাসির এক ছেলে ইপিআরএ চাকুরী করে,সে বিদ্রোহ করে মুক্তিবাহিনীতে চলে গেছে।তার বৃদ্ধ পিতা রহিম খালাসিকে ধরে এনে তিন রাস্তার মোড়ে বড় আমগাছটার সাথে ঝুলিয়ে ইচ্ছামত পেটায় আর্মিরা, শতশত লোক সেই দৃশ্য দেখে ভয়ে আতকে উঠে। অত্যাচার নির্যাত সইতে না পেরে রাতেই রহিম খালাসী মারা যায়।কাজী ডাংগীর মুন্নাফ কাজীর বড় ছেলে হান্নান মিয়া আর্মি থেকে পালিয়ে চলে গেছে।তাকে রাতে ধরে এনে খালের পাশে গুলি করে বুকটা ঝাঝরা করে ফেলে।তিনদিন পর মুন্নাফের লাশ ভেসে ওঠে।রহিম খালাসীর লাশ দুইদিন ওভাবেই গাছে ঝুলে থাকে।শেষে খবর পেয়ে সবুর মিয়া গিয়ে আর্মিদের বুঝিয়ে শুনিয়ে লাশ নামানোর ব্যবস্থা করে।রহিম মিয়া তার একজন বড়মাপের মুরিদ ছিলো। সবুর মিয়ার এমন মহৎ কাজে এলাকায় তার সুনামও ছড়িয়ে পড়ে।প্রিন্সিপ্যাল স্যার কিছুদিন এলাকায় চলাফেরা করলেও এলাকার কিছু লোকের পরামর্শে শেষপর্যন্ত (প্রিন্সিপ্যাল স্যারও)পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।মেলিটারিরা ঘন ঘন এলাকায় হানা দিতে শুরু করেছে। তাকে কয়েকদিন জেরা করেছে তার কলেজের ছাত্ররা মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানোর কারণে।
দিনের বেলায় একটু কম হলে রাতে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী যাদের বাড়িতে সুন্দরী মেয়ে, বউ আছে তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়।নিজেরা অত্যাচার করার পর তুলে দেয় হানাদারদের হাতে।বটতলার আশেপাশে তিনগ্রামের পঁয়ত্রিশ ঘর হিন্দু পরিবারের পনেরো ঘরই মেলিটারি -রাজাকারদের ভয়ে রাতের অন্ধকারে এলাকা ছেড়েছে।দেশ ছেড়ে যাওয়া এসব হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করে বেশিরভাগের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।আইয়ুব আলী তার গ্রামের খিতিশ রায়ের দুটি একুশ বন্দের টিনের ঘর নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে।কাশেম সুদিও হারাধন বিশ্বাসের ঘরগুলো পানির দামে কিনে নিয়েছে!হাকিম খাঁ জোগেশ সাহার ধানী জমিতে কামলা লাগিয়ে নিড়ানী দেয়া শুরু করেছে।জোগেশ নাকি সব জমি তার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে!দিন দিন খানসেনা রাজাকারদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়।বাড়ির মেয়েদের দিকে ওদের কুনজর পড়েছে।ব্যবসায়ী গনেশ দাশের তিন ভাই আগেই ওপারে পালিয়েছে। এতদিন সাহস করে বাড়িতে থাকলেও এবার গ্রামে আর্মি হানা দেওয়ায় তিনটি মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়ে যায় গনেশ দাশ। দেশ না ছাড়ার জন্য বউ বকাবকি শুরে করছে।গভীররাতে সে সবুর মিয়ার বাড়িতে আসে ঈমান আলীর মাধ্যমে।দক্ষিণের ঘরে মাটিতে কাচু মাচু হয়ে বসতে গেলে -
সবুর মিয়া বলে:না, না, মশাই,মাটিতে কেন? আপনি মোড়ায় বসেন।আপনি আমাগো এলাকার সুন্মানি লোক!আপনার বাড়িতে মেলিটারি গেছে এটা আমার জন্যও বড় লজ্জার। আসলেও ওরাতো কুত্তার লাহান!ওগো মনে চাইলে ওরা আমাগো কারো কথাই শুনেনা।কেউ হয়ত আপনার ব্যাপারে লাগিয়ে দিয়েছে?আমিতো প্রথম দিনই ওদেরকে বলেছি আমার এলাকায় কোন মুক্তি নেই,আওমীলীগ নেই। আপনাকে নিয়ে আমিও বড় চিন্তায় আছি।আর কতদিন যে ওগো ঠেকাইয়া রাখতে পারবো?দেশের অবস্থা মোটেও ভালো না।এলাকার যুবক পুলানগুলাই আর্মির মাথাডা নষ্ট কইরা দিছে।
গনেশ দাস:আমিতো আর দেশে থাকতে চাইতাছি না হুজুর।আপনে অনুমতি দিলে কাল রাতেই ওপাড়ে যাইতে চাই। আমার বটতলার সাত বুইঘা জমির বাটটা,আর আমার বাড়িটা আপনার কাছে দিয়া যাইবার চাই।যদি কুনো সময় ফেরত আসি তাহলে আপনার কাছ থেকে নিমু। আপনে ছাড়া কারে বিশ্বাস করমু,ভরসা তো পাইনা ? আপনেতো আমাগো সকলের হুজুর।আপনারেই বিশ্বাস করি,মানি।আমার মুদি দোকানডা আমার এক ভাতিজাই দেখবো।আপনে যদি তারে একটু দেইখ্যা রাখেন,সুনজর দেন,তাহলে একটু সাহস পাই।মাল ছামানাতো অনেক আছে দোকানে।
সবুর মিয়া:মশাই,আমারে বড় বিপদে ফালাইলেন। আমি কত্তজনের জিনিসপত্র দেইখ্যা রাখুম?শেষেতো আমার বদনাম অইয়া যায়বো!মানুষের মুখ বড় পাতলা!হরি বাবু,গোসাই বাবু, রমা বাবুরাও দিয়া গেলো কত্তগুলো সোনা দানা,রমেশ বাবু আবার টাকা পয়সাও রাইখ্যা গেলো জোর কইরা।গোষাল বিশ্বাস পালের গরুগুলো আইন্যা দিয়া গেলো!মানুষের আমানত বড় মারাত্মক, ওরা একবার টের পাইয়া গেলে আমারেই না আবার জানে মাইরা ফালায়!কি যে অইবো কওন যায়না? মুক্তিরা নাকি বিভিন্ন এলাকায় আবার চুরি কইরা হামলা শুরু কইরা দিছে?
আপনারাতো মশাই আমার কথা এলেকশনের সময় কেউই শুনলেন না ? আপনাগো কথা না হয় বাদ দিলাম কিন্তু আমাগো মুসলমানরা কী কামডা করলো!এত্ত কইরা কইলাম মুসলিম লীগরে ভোট দেন।দিলেন না,হুড়মুড় কইরা পড়লেন গিয়া নৌকায়!আপনাগো প্রিন্সিপ্যালের বাড়ি সেদিন আমিই বাঁচাইয়া দিলাম।কিন্তু কালামের, বাদশার বাড়ি, রহমান মিয়ার বাড়িডা সেইদিন বাঁচাইতে পারলাম না। আফসোস লাগে মশাই!এরাতো সবাই আমারে খাওয়াইছে,সন্মান করছে ইজ্জতও করছে।আজ তাগো লাইগা খারাপ লাগে।মনে তো চায় উপকার করি কিন্তু তাগো পুলাপান গুলা অইছে গিয়া আস্ত গাদ্দার! ওরা মুক্তিবাহিনী গঠন কইরাই আসল ভেজালডা লাগাইলো।আমিতো মেলিটারিগো ঠিকই বুঝাইয়া দিছিলাম এলাকায় মুক্তি-ফুক্তি নাই। কত্তজনরে যে বাঁচাইলাম! এইভাবে আর কয়দিন সবাইরে বাঁচামু!
কই তারা, বাপের বেটারা এহন এলাকায় নাই কেন?এত্ত নাকি সাহস মুক্তিগো?খানগো লগে মাতুব্বরি চলেনা মশাই।তয় আপনাগো মান ইজ্জত যাওয়ার আগে আমার মনে হয় ওপাড়ে যাওনই ভালো।সুযোগ পাইলেতো আবার আসবেনই।বাড়ি ঘর টেকা -পয়সা -জমি -জমা গেলে তা ফিরে পাওয়া যায় কিন্তু ইজ্জত?ইজ্জত গেলেতো সবই শেষ।আপনে যদি একান্ত যাইতে চান আমি লোকজন দিয়া একটা ব্যবস্থা কইরা দিমুনি।ওরা হয়ত আবার হিন্দু পাড়ায় হানা দিবো।
Comments