হাকুল্লা
গত কাল একটা বিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। সাধারণত এইসব অনুষ্ঠান আমি এখন এড়িয়ে চলি। কাল করার মত কোন কাজও ছিল না, আর বিয়ের অনুষ্ঠান হাতের কাছে। তাই গেলাম বিয়ে খেতে। যাওয়ার পরে মনে হয়েছে, বিরাট ভুল করেছি। বিয়ের কনে ছাড়া কেউ আমাকে চিনে না। আর কনে তখনও কমিউনিটি সেন্টারে এসে উপস্থিত হয় নি। সে পার্লারে আছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, হাকুল্লা (বিনা দাওয়াতে খাওয়া) খেতে এসেছি। জড়সড় হয়ে এক কোনায় একাকি বসে আছি। খাবার শুরু হয়ে গিয়েছে। খেয়ে চলে যাব, নাকি কনের জন্য আর একটু অপেক্ষা করব তাই ভাবছি। আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। অথচ এককালে কত হাক্কুল্লাহ খেয়ে বেড়িয়েছি। তখন কত সাবলীল ছিলাম। এখন বয়সের জন্য কত কি ছেড়ে দিতে হয়েছে।
এক ভদ্রলোক এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল। আমাকে বলল, আপনাকে খুব পরিচিত লাগছে, কোথায় দেখেছি বলেন তো? আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না। সাদা একটা পাঞ্জাবি পরে আছে। আমি বললাম, মনে করতে পারছি না। মানুষ চেনার ব্যাপারে আমার স্মৃতিশক্তি খুব দূর্বল। ভদ্রলোক আবার বলল, আমার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। কিন্তু কোথায় যে দেখেছি, কিছুতে মনে করতে পারছি না। আপনি কোন পক্ষের? আমি বললাম, কনে পক্ষের। ভদ্রলোক বলল, আমি বর পক্ষের। আমি বললাম, বরযাত্রী তো এখনো আসে নি। তাতে কি হয়েছে। আমি আগে চলে এসেছি। বরের বাড়ি দিয়ে আসতে হলে আমাকে উল্টা দিকে যেতে হয়। আমি বললাম, বুঝতে পেরেছি। ভদ্রলোক বলল, চলেন একবার খেয়ে নিবেন নাকি? আমি বললাম, বরযাত্রী আসার আগে খেয়ে নিবেন, ভালো দেখাবে? ভদ্রলোক বলল, সেটাও ঠিক। তবে ক্ষুধা লেগেছে বেশি। অল্প করে খাই। তারা আসলে না হয় আর একবার বসা যাবে? আমি বেশ অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। ভদ্রলোক বলল, ভাই, দুনিয়া হচ্ছে খাওয়ার পাগল। এত অবাক হবার কি আছে? আসেন তো আমার সাথে। এরপর আর না কথা যায় না। আর তাছাড়া আমি নিজেও এখন খেয়ে কেটে পড়তে চাচ্ছিলাম।
খাবার বসে ভদ্রলোক আমার গ্লাসে বোরহানি ঢেলে দিতে চাচ্ছিল। আমি বললাম, আমি বোরহানি খাই না। সে বলল, আপনি তো আসল জিনিসই খান না। যাইহোক, খাওয়ার সময় আর ভদ্রলোক বেশি কথা বলল না। খাওয়ার দিকে তার বেশি মনোযোগ। সে যেভাবে খাচ্ছে, বরযাত্রী আসলে আরেকবার খাবে বলেছিল, সেটা মনেহয় আর খাবে না। বিরিয়ানি, মাংস খাবার শেষে মিষ্টি আসল। আমি বললাম, মিষ্টি আমি খাই না। ভদ্রলোক তখন বলল, আপনাকে আমি মনেহয় চিনতে পারছি। আপনার বাসা কি পুরান ঢাকায়? আমি বললাম, না তো। তবে একসময় সেখানে ছিলাম। হাত ধোয়ার পর সে বলল, আপনি কি আগে বিয়ে বাড়ি খেয়ে বেড়াতেন? আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। সে বলল, আরে এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? দুনিয়ার কত মানুষ কত কি করে বেড়ায়! আমরা না হয় একটু বিনা দাওয়াতে বিয়ে খেয়ে বেড়ায়, তাতে কি এমন ক্ষতি? একটা বিয়েতে কত খাবার নষ্ট হয় জানেন? আমি অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকালাম। সেকি আজকে বিনা দাওয়াতে খেতে এসেছে? অল্প বয়সে আমি না হয় একটু দুষ্টামি করেছি। কিন্তু এখন কি আর তার সেই বয়স আছে?
আমি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বর পক্ষের না? সে বলল, আপনি কোন দেশে আছেন? বর পক্ষের হলে কি আর আপনার সাথে চুপিচুপি খাই? আপনি যেমন কন্যাপক্ষ সেজেছেন আমারটাও একই রকম। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি বাহিরে চলেন। এখানে কেউ জানতে পারলে একটা খারাপ অবস্থায় পড়ে যাবেন। ভদ্রলোক বলল, এত বছরের অভিজ্ঞতা, জানবে কিভাবে? হাকুল্লা খাওয়ার সবচে’ সহজ বুদ্ধি কি জানেন? দাঁড়ান, আপনাকে শিখাই। আপনি বিয়ে বাড়িতে ঢুকে কনের বাবাকে খুঁজে বের করে তার সাথে কথা বলা শুরু করবেন। কনের বাবাকে খুঁজে বের করাও খুব সহজ। সে এমন এক ঘোরের মধ্যে থাকে, কে যে তার পরিচিত আর কে অপরিচিত তার বুঝার ক্ষমতা নাই। আর আপনি যখন কনের বাবার সাথে কথা বলবেন, অন্যরা দেখবে- তখন কেউ ভুলেও জিজ্ঞেস করবে না- আপনি কে? আপনাকে প্যাক্টিক্যাল দেখায়।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভদ্রলোক উঠে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে বলল, আপনার জন্য একটা পান নিয়ে এসেছি। কনের বাবা নিজ হাতে আমাকে দিল। আমি বললাম, পান খাব না। আপনি চলেন তো? ভদ্রলোক আর আমি বের হয়ে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখন কনে বিউটি পার্লার থেকে এসে গাড়ী থেকে নামছে। আমি একপলক দেখলাম। নুসরাতকে চেনা যাচ্ছে না। বিয়ের সাঁজ মেয়েদেরকে বদলে দেয়। নুসরাত আধা আলো আধা অন্ধকারে আমাকে চিনে ফেলল। আমাকে ডাক দিল, অভি ভাই? আর কাছে না গিয়ে উপাই নেয়। আমাকে নুসরাত বলল, আমার পাশে দাঁড়াও তো। ফটোগ্রাফারকে সে বলল, কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দেন? আমি মাথা হেলে নুসরাতের সাথে একটু ভদ্র দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। নুসরাতের সাথের আর সব মেয়েরা নুসরাতকে ভিতরে নিয়ে চলে গেল। আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না।
পুরো ঘটনাটি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থেকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেল। বাহিরে বের হয়ে আমাকে বলল, ভাই মাফ করে দিয়েন। আপনাকে ভেবেছিলাম আমার মত হাকুল্লা খেতে এসেছেন। এখন দেখি কেস অন্য। আমি বললাম, কি কেস? ভদ্রলোক বলল, আমার থেকে আপনাকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। কনে কি আপনার প্রেমিকা ছিল? সব প্রশ্নের উত্তর সবসময় চট করে দেওয়া যায় না। আমি বললাম, পান তো এখনো হাতে ধরে আছেন। আমাকে দেন, খাই।
Comments