হিন্দু ধর্মে ধর্ষণ
দেবতাদের আমরা সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ভাবতেই ভালোবাসি। ভক্ত বিশ্বাস করে, ভগবান কেবলই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে থাকেন। কিন্তু সেই দেবতাই যদি হয়ে ওঠে শয়তান, লম্পট ও ধর্ষক? তবে কি মানুষ তার বিবেকের কাঠগোড়ায় দেবতাকেও দাঁড় করাবে? নাকি ক্ষমতাবলে ছাড় পেয়ে যাবে ভ্রষ্ট দেবতা? বর্তমান সময়ে নারীদের উপর বেড়ে চলা সহিংসতা,ধর্ষণ আমাদের যখন বিব্রত করে চলেছে তখন ধর্মগ্রন্থগুলোতে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে সত্যযুগ থেকে কলিযুগ অবধি কিছুই বদলায়নি। কলির অধঃপতিত পুরুষের মত সত্যের পরমপূজ্য ঋষি,দেবতারাও ধর্ষণের ন্যায় অপকর্মে জড়িত। বৃহস্পতিপ্রথমে দেবগুরু বৃহস্পতির কথা দিয়ে শুরু করা যাক।দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি তার ভ্রাতৃবধূ মমতাকে ধর্ষণ করেন। বৃহস্পতির ভাই ছিলেন উতথ্য ঋষি। তার স্ত্রী হলেন মমতা। একদিন বৃহস্পতি কামাতুর মনে মমতার কাছে উপস্থিত হন। তাকে দেখে মমতা জানান তিনি তার স্বামী অর্থাৎ বৃহস্পতির দাদা উতথ্য ঋষির দ্বারা গর্ভবতী হয়েছেন। এক গর্ভে যেহেতু দুই সন্তানের স্থান হওয়া অসম্ভব এবং বৃহস্পতিও অমোঘরেতাঃ তাই মমতা বৃহস্পতির সাথে মিলিত হতে অসম্মতি জানান-“হে মহাভাগ! আমি তোমার জ্যেষ্ঠের সহযোগে অন্তর্বত্নী হইয়াছি, অতএব রমণেচ্ছা সংবরণ কর। আমার গর্ভস্থ উতথ্যকুমার কুক্ষিমধ্যেই ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ণ করিতেছেন। তুমিও অমোঘরেতাঃ ; এক গর্ভে দুইজনের সম্ভব নিতান্ত অসম্ভব।অদ্য এই দুব্যবসায় হইতে নিবৃত্ত হও।”মমতার অসম্মতি সত্বেও দেবগুরু বৃহস্পতি তাকে ধর্ষণ করেন। বৃহস্পতিকে ধর্ষণ করতে দেখে মমতার গর্ভস্থ শিশু বলে ওঠে, “ভগবন! মদনাবেগ সংবরণ করুন। স্বল্পপরিসরে উভয়ের সম্ভব অত্যন্ত অসম্ভব। আমি পূর্বে এই গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, অতএব অমোঘরেতঃপাত দ্বারা আমাকে পীড়িত করা আপনার নিতান্ত অযোগ্য কর্ম হইতেছে, সন্দেহ নাই।”বৃহস্পতি গর্ভস্থ শিশুটির কথায় কর্ণপাত না করে তার নিকৃষ্ট কাজ করতে থাকেন। গর্ভস্থ শিশু বৃহস্পতির এই অন্যায় আচরণ দেখে নিজের পা দিয়ে শুক্রের পথ রোধ করেন।বীর্য মমতার গর্ভে প্রবেশ করতে না পেরে মাটিতে পতিত হয়। এতে রেগে গিয়ে বৃহস্পতি সেই শিশুটিকে অন্ধ হওয়ার অভিশাপ দেন।পরে ওই শিশুটির নাম হয় দীর্ঘতমা।[কালিপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদিত মহাভারত / আদিপর্ব / চতুরধিকশততম অধ্যায় (১০৪ অধ্যায়)]চন্দ্র চন্দ্র দেবতা বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে ধর্ষণ করেছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এই ঘটনাটি উল্লেখিত আছে –“তারারে হরণ করে দেব শশধর।তারাদেবী গর্ভবতী হয় অতঃপর।।সগর্ভা তারারে হেরি গুরু বৃহস্পতি।ভর্ৎসনা করিল তারে ক্রোধভরে অতি।।লজ্জিত হইয়া তারা চন্দ্রে দিল শাপ।শুন শুন চন্দ্র তুমি করিলে যে পাপ।।কলঙ্কী হইবে তুমি তাহার কারণ।তোমার দর্শনে পাপ হবে অনুক্ষণ।।“[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/ কৃষ্ণ জন্ম খন্ড/৮০ অধ্যায়,অনুবাদক- সুবোধ চন্দ্র মজুমদার]অশ্বীনিকুমারব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অশ্বীনিকুমারের এক ব্রাহ্মণীকে ধর্ষণের ঘটনা উক্ত হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড/১০) বলা হয়েছে,“শৌনক কহিলা সৌতি না পারি বুঝিতেঅশ্বীনিকুমার কেন রত ব্রাহ্মণীতে।।সৌতি কহে মুনিবর দৈবের ঘটনা ।ব্রাহ্মণী তীর্থেতে যায় অতি সুদর্শনা।।পথশ্রমে ক্লান্ত অতি বিশ্রাম কারণ।পশিল দেখিয়া এক নির্জন কানন।।ব্রাহ্মণী বসিয়া আছে বিশ্রামের আশে।অশ্বীনিকুমার দৈবযোগে তথা আসে।।তাহারে দেখিয়ে পথে অশ্বীনিকুমার।সৌন্দর্যবিমুগ্ধ মনে কাম জাগে তার।।সুন্দরীর রূপ দেখি কাম জাগে মনে।তাহারে ধরিতে যায় অতি সঙ্গোপনে।।রূপবতী সতী নারী নিষেধ করিল।কামার্ত অশ্বীনিপুত্র তাহা না শুনিল।।নিকটেই মনোহর ছিল পুষ্পোদ্যান।সবলে আনিয়া সেথা করে গর্ভাধান।।লজ্জ্বা ভয়ে ব্রাহ্মণী সে গর্ভত্যাগ করে।তখনি জন্মিল পুত্র ধরার উপরে।।“[অনুবাদক- সুবোধ চন্দ্র মজুমদার]বরুণমহাভারতে (অনুশাসন পর্ব / ১৫৪) বরুণদেবকে চন্দ্রের কন্যা উতথ্যের স্ত্রী ভদ্রার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে হরণ করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও বরুণ যখন ভদ্রাকে ফিরিয়ে দিলেন না, উতথ্য তখন সমস্ত জলরাশি পান করতে উদ্যত হলে ,বরুণ ভয় পেয়ে ভদ্রাকে ফিরিয়ে দেন-“বহুকাল পূর্বে বরুণ নারীটির প্রতি অভিলাষী হয়েছিলেন।উতথ্যের স্ত্রী যখন যমুনায় স্নান করতে যাচ্ছিলেন তখন উতথ্য যে বনে বাস করতেন সেখানে উপস্থিত হয়ে বরুণ তার স্ত্রীকে হরণ করেন। তাকে অপহরণ করে বরুণ তাকে তার ভবনে নিয়ে যান।… বরুণ তার সাথে বিহার করেন।…” [1]সূর্যঘটনাটি কুন্তির বিবাহের আগের। কুন্তির সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে দুর্বাসা মুনি কুন্তিকে একটি মন্ত্র দিয়েছিলেন, যে মন্ত্রবলে দেবতাদের সঙ্গমের জন্য ডাকা যেত। মন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য কুন্তি মন্ত্রবলে সূর্যকে ডাকেন। সূর্যও সত্যি সত্যি মানুষের রূপ ধরে কুন্তির সামনে এসে উপস্থিত হন। অবিবাহিতা কুন্তি সূর্যকে দেখে ভয় পেয়ে যান এবং তাকে ফিরে যেতে বলেন। সূর্য ফিরে যেতে সম্মত হন না বরং কুন্তিকে অভিশাপের ভয় দেখিয়ে তার সাথে সহবাস করেন।সূর্য কুন্তিকে বলেছিলেন, “ আমি যদি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাই তবে দেবতাদের নিকট হাসির বস্তুতে পরিণত হব। হে কুন্তি! তুমি যদি আমাকে সন্তুষ্ট না কর তবে আমি তোমাকে এবং যে ব্রাহ্মণ তোমাকে মন্ত্রটি দিয়েছে তাকে অভিশাপ দেব।“ [2]এছাড়া সূর্য কুন্তিকে বর দিয়েছিলেন যে সন্তান প্রসবের পরও কুন্তির কুমারিত্ব বজায় থাকবে।ভয় দেখিয়ে নারী সহবাসকে ধর্ষণ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?[দেবী ভাগবত ২/৬ ;অনুবাদক-স্বামী বিজ্ঞানানন্দ]ইন্দ্রসৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা অহল্যা নামের এক অপরূপা নারীকে সৃষ্টি করেছিলেন। ‘অহল্যা’ শব্দের অর্থ হল ‘অনিন্দনীয়া’। ‘যার মধ্যে কোনো বিরূপতা নেই তিনিই অহল্যা’। এই জন্যেই ব্রহ্মা নারীটির ‘অহল্যা’ নামকরণ করেন। ‘অহল্যা কার পত্নী হবেন- এই নিয়ে স্রষ্টা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। দেবতাদের রাজা হওয়ার কারণে ইন্দ্র ভাবলেন, অহল্যা তারই পত্নী হবেন কিন্তু ব্রহ্মা অহল্যাকে গৌতম মুনির কাছে গচ্ছিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বহুকাল পরে গৌতম অহল্যাকে পুনরায় ব্রহ্মার কাছে ফিরিয়ে দেন। গৌতমের সংযম দেখে ব্রহ্মা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং অহল্যাকে তার স্ত্রী করে দেন। অহল্যাকে গৌতমের স্ত্রী হতে দেখে দেবতারা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এতে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র ভীষণ রেগে যান এবং গৌতমের আশ্রমে উপস্থিত হয়ে ক্রুদ্ধ ইন্দ্র অহল্যাকে দেখতে পান।এর পর একই ঘটনার দুই ধরণের বিবরণ বাল্মীকির রামায়ণে পাওয়া যায়। একটি অনুসারে ইন্দ্র অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন। অপরটি অনুসারে অহল্যা ইন্দ্রের সাথে ব্যভিচারে রত হয়েছিলেন।ইন্দ্রের অহল্যা ধর্ষণ প্রসঙ্গে ব্রহ্মা বলেন,“ ইন্দ্র তুমি কামপীড়িত হইয়া অহল্যাকে বলাৎকার করিলে…”অহল্যাকে ধর্ষণ করে পালানোর সময় ইন্দ্র গৌতমের কাছে ধরা পড়ে যান।ক্রুদ্ধ গৌতম ইন্দ্রকে দেখতে পেয়ে, কুপিত হয়ে ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন,“ ইন্দ্র! তুমি নির্ভয় চিত্তে আমার পত্নীকে বলাৎকার করেছ। সুতরাং দেবরাজ ,তুমি যুদ্ধে শত্রুর হস্তগত হবে। দেবেন্দ্র! এইজন্যই তোমার দশা পরিবর্তন ঘটেছে। তুমি ইহলোকে যে ভাব প্রবর্তিত করলে, তোমার দোষে মনুষ্যলোকেও এই জারভাব প্রবর্তিত হবে, পাপের অর্ধেক অংশ তার হবে এবং পাপের অর্ধেক অংশ তোমাকে স্পর্শ করবে; আর তোমার স্থান স্থির থাকবে না, এতে সংশয় নাই। যিনি যিনি দেবতাদের রাজা হবেন তিনি স্থির থাকবেন না”এরপর গৌতম তার পত্নী অহল্যাকে অতীব তিরস্কার করেন। গৌতম বলেন,“ আমার আশ্রমের কাছে তুমি সৌন্দর্যহীনা হয়ে থাক। তুমি রূপবতী এবং যুবতী বলেই গর্বে অস্থির হয়েছ, বিশেষত এতদিন পর্যন্ত তুমি একাকিনীই ইহলোকে রূপবতী ছিলে, কিন্তু এখন আর তা হবে না, তোমার একত্রস্থিত রূপরাশি দেখেই ইন্দ্রের দেহবিকার জন্মেছে; সুতরাং তোমার রূপ প্রজামাত্রেই পাবে, সন্দেহ নাই।“এই কথা শুনে অহল্যা বলেন,“বিপ্রশ্রেষ্ঠ! স্বর্গবাসী ইন্দ্র তোমার রূপ ধরে অজ্ঞানবশত আমাকে বলাৎকার করেছে, বিশেষত আমার কামাচারবশত এটা সংঘটিত হয়নি”[বাল্মীকি রামায়ণ/ উত্তর কাণ্ড/ ৩৫ সর্গ]বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী,শঙ্খচূড় বরপ্রাপ্ত ছিল, যতক্ষণ অবধি তার পত্নী তুলসীর (তথাকথিত) সতীত্ব বজায় থাকবে, ততক্ষণ শঙ্খচূড় যুদ্ধে অপরাজেয় থাকবে। সুতরাং শঙ্খচূড়কে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য ভগবান বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের রূপ ধরে শঙ্খচূড়ের পত্নী তুলসীকে ধর্ষণ করেন। তুলসীকে ধর্ষণ করার পর শঙ্খচূড়কে সহজেই হত্যা করা হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ভগবান বিষ্ণুর ধর্ষণ লীলা এইভাবে বর্ণিত আছে-“কবচ গ্রহণ করি বিষ্ণু অতঃপর।তুলসীর নিকটেতে চলিলা সত্ত্বর।।শঙ্খচূড় রূপে সেথা করিয়া গমন।তুলসীর সতীধর্ম করিলা হরণ।।না জানিলা দৈত্যপত্নী কি পাপ হইল।দেবতা ছলনা করি সতীত্ব নাশিল।।যেইক্ষেত্রে বিষ্ণুদেব করিলা রমণ।তুলসী উদরে বীর্য হইল পতন।।সেইক্ষণে মহাদেব দৈববাণী শোনে।শঙ্খচূড়ে বধ তুমি করহ এক্ষণে।।“[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ১৩৬ পৃষ্ঠা ,সুবোধচন্দ্র মজুমদারের অনুবাদ]ভগবান বিষ্ণু বৃন্দা নামক এক নারীকেও ধর্ষণ করেন। স্কন্দপুরাণে ঘটনাটির উল্লেখ আছে। অসুরদের রাজা জলন্ধর ক্রুদ্ধ হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিল। জলন্ধরের পরাক্রমে দেবতারা তার বশীভূত হয়েছিল।এরপর একসময় শিবপত্নী পার্বতীর প্রতি মোহিত হয়ে শিবের কাছ থেকে পার্বতীকে নিয়ে আসার জন্য জলন্ধর দূত প্রেরণ করে। জলন্ধরের সেই ইচ্ছা পূরণ না হলে জলন্ধর বিশাল সৈন্য নিয়ে শিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে। শিবের সাথে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এক মায়ার দ্বারা শিবকে জলন্ধর বশীভূত করলে, শিবের হাত হতে সকল অস্ত্র পতিত হয়। এই সময়ে জলন্ধর কামার্ত হয়ে, শিবের রূপ ধারণ করে শিবপত্নী গৌরি যেখানে উপস্থিত ছিলেন সেখানে উপস্থিত হন। দূর থেকে পার্বতীকে দেখে জলন্ধরের বীর্য পতিত হয়। পার্বতীও শিবরূপী জলন্ধরকে চিনতে পেরে, সেখান থেকে পালিয়ে যান। জলন্ধরও শিবের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ফিরে আসেন। এরপর, পার্বতী বিষ্ণুকে স্মরণ করতে থাকেন। পার্বতীর আহ্বানে বিষ্ণু উপস্থিত হলে পার্বতী তাকে বলেন,” হে বিষ্ণু! দৈত্য জলন্ধর আজ এক পরম অদ্ভুত কর্ম করিয়াছে; তুমি কি সেই দুর্মতি দৈত্যের ব্যবহার বিদিত নহ?” [3]বিষ্ণু উত্তর দেন,” হে দেবী! জলন্ধরই পথ দেখাইয়াছে, আমরাও সেই পথের অনুসরণ করিব, ইহা না করিলে জলন্ধরও বধ হইবে না এবং আপনারও পাতিব্রাত্য রক্ষিত হইবে না।” [4]“জলন্ধর যখন শিবের সাথে যুদ্ধে রত, তখন “বিষ্ণু দানবরাজপত্নী বৃন্দার পাতিব্রাত্য ভঙ্গ করিবার অভিলাষে বুদ্ধি করিলেন এবং তখনই জলন্ধরের রূপ ধারণ করিয়া, যথায় বৃন্দা অবস্থিত ছিলেন, সেই পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন।” [5]এইখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বৃন্দা হল জলন্ধরের স্ত্রী।সেইসময়ে জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা এক দুঃস্বপ্ন দেখে তার স্বামীর জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং এক ঋষির দেখা পায়। বৃন্দা সেই ঋষির কাছে জলন্ধরের অবস্থা জানতে চাইলে, মুনির আদেশে দুটি বানর জলন্ধরের মাথা ও ধর নিয়ে উপস্থিত হয়। তা দেখে বৃন্দা শোকগ্রস্ত হয়ে মূর্ছিত হয়ে ভূমিতে পতিত হয়। পরে জ্ঞান ফিরলে জলন্ধরের স্ত্রী সেই ঋষির কাছে তার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। তার অনুরোধে সেই ঋষি নিজে সেই স্থান হতে অদৃশ্য হয়ে যান এবং সাথে সাথেই বৃন্দা জীবিত জলন্ধরকে সেই স্থানে দেখতে পায়।জলন্ধর জীবিত হয়ে, ” প্রীতিমান বৃন্দাকে আলিঙ্গন করিয়া তাহার গলদেশে চুম্বন করিল”। “অনন্তর বৃন্দাও স্বামীকে জীবিত দেখিতে পাইয়া সুখীমনে সেই কাননমধ্যে অবস্থিত হইয়া তাহার সহিত রতি করিতে লাগিল।” একদিন বৃন্দা জলন্ধররূপী বিষ্ণুকে চিনতে পারে। [6]ক্রুদ্ধ হয়ে বৃন্দা বলে,” হে হরে! তুমি পরদারগামিনী (অন্যের স্ত্রীকে সম্ভোগকারী), তোমার চরিত্রে ধিক!” [7]বিষ্ণুকে তীরস্কার করে, অভিশাপ দিয়ে , আত্মহত্যা করার জন্য বৃন্দা আগুনে প্রবেশ করে। “বৃন্দাসক্তমনা (বৃন্দার প্রতি আসক্ত) বিষ্ণু তাঁহাকে বারণ করিলেও তিনি তাহা শুনিলেন না। অনন্তর হরি বারবার তাঁহাকে স্মরণ পূর্বক দগ্ধদেহ বৃন্দার ভস্ম-রজো দ্বারা শরীর আবৃত করিয়া সেই স্থানেই অবস্থিত হইলেন, সুর ও সিদ্ধগণ তাঁহাকে সান্ত্বনা দান করিলেও তিনি শান্তি লাভ করিলেন না।” [8]রাক্ষস বিবাহহিন্দু শাস্ত্রে আটপ্রকারের বিবাহের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যথাঃ ব্রাহ্ম,দৈব,আর্য,প্রাজাপত্য,আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ। (মনু ৩/২৩) এই বিবাহগুলির মধ্যে আমাদের আলোচ্য বিবাহ হল রাক্ষস বিবাহ। মনুসংহিতায় রাক্ষস বিবাহ সম্বন্ধে বলা হয়েছে,“কন্যাপক্ষের লোকদের হত্যা করে,আহত করে কিংবা তাদের বাসস্থান আক্রমণ করে রোদনরত কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে যে বিবাহ তাকে রাক্ষস বিবাহ বলে। (মনু ৩/৩৩)এই ধরণের অপহরণ করে বিবাহকে ধর্ষণ না বলে আর কি বলা যায়? কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল আগেকার হিন্দু সমাজে এই প্রকারের ধর্ষণ তুল্য বিবাহ বৈধতা পেয়েছিল। রাক্ষস বিবাহকে ক্ষত্রিয় জাতির জন্য বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল-“… শেষ চারটি বিবাহ অর্থাৎ আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বৈধ”। (মনু ৩/২৩)এমনকি রাক্ষস বিবাহকে ধর্মজনক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে-“… এই মানবশাস্ত্র মতে প্রাজাপত্য,আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ – এই পাঁচ প্রকারের বিবাহের মধ্যে প্রাজাপত্য,গান্ধর্ব ও রাক্ষস- এই তিনপ্রকার বিবাহ ধর্মজনক।“ (মনু ৩/২৫)“ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব ও রাক্ষস বিবাহ পৃথক পৃথকভাবে অথবা মিশ্রিতভাবে যেভাবেই সম্পাদিত হোক না কেন, দুই প্রকার বিবাহই ধর্মজনক…” (মনু ৩/২৬)শাস্ত্রে রাক্ষস বিবাহের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। ভীষ্ম তার ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য কাশিরাজের তিন কন্যা অম্বা,অম্বিকা ও অম্বালিকাকে অপহরণ করে এনেছিলেন। [9] দুর্যোধনের সাথে কলিঙ্গ রাজ চিত্রাঙ্গদের কন্যার বিবাহ দেওয়ার জন্য স্বয়ংবরসভা থেকে তাকে বলপূর্বক হরণ করে আনেন কর্ণ।[10]দেবকের রাজসভা থেকে দেবকীকে শিনি বলপূর্বক অধিকার করে এনেছিলেন বসুদেবের সাথে বিবাহ দেবার জন্য। [11] কৃষ্ণের মন্ত্রণায় অর্জুন কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে হরণ করেছিলেন। সুভদ্রাকে দেখে অর্জুনের পছন্দ হলে কৃষ্ণ অর্জুনকে সুভদ্রা লাভের পরামর্শ দেওয়ার সময় বলেন, ” হে অর্জুন! স্বয়ংবরই ক্ষত্রিয়দিগের বিধেয়, কিন্তু স্ত্রীলোকের প্রবৃত্তির কথা কিছুই বলা যায় না, সুতরাং তদ্বিষয়ে আমার সন্দেহ জন্মিতেছে। আর ধর্ম শাস্ত্রকারেরা কহেন, বিবাহোদ্দেশ্যে বলপূর্বক হরণ করাও ক্ষত্রিয়দিগের প্রশংসনীয়। অতএব স্বয়ংবরকাল উপস্থিত হইলে তুমি আমার ভগিনীকে বলপূর্বক হরণ করিয়া লইয়া যাইবে। কারণ স্বয়ংবরে সে কাহার প্রতি অনুরক্ত হইবে, কে বলিতে পারে?” কৃষ্ণের পরামর্শ মত অর্জুন সুভদ্রাকে রৈবতক পর্বতে পূজা সেরে ফেরার সময় অপহরণ করেন। এ ঘটনায় সুভদ্রার পরিবার ও বংশের লোকেরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলে কৃষ্ণ তাদের শান্ত করেন। কৃষ্ণ বলেন, ” … স্বয়ংবরে কন্য লাভ করা অতীব দুরূহ ব্যাপার, এই জন্য (অর্জুন) তাহাতেও সম্মত হন নাই এবং পিতামাতার অনুমতি গ্রহণপূর্বক প্রদত্তা কন্যার পাণিগ্রহণ করা তেজস্বী ক্ষত্রিয়ের প্রশংসনীয় নহে।অতএব আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, কুন্তিপুত্র ধনঞ্জয় উক্ত দোষ সমস্ত পর্যালোচনা করিয়া বলপূর্বক সুভদ্রাকে হরণ করিয়াছেন…” [12]উপনিষদের অমানবিকতাসঙ্গমে আগ্রহহীনা নারীকে লাঠি দিয়ে প্রহার করে সঙ্গমের জন্য রাজি করানোর কথা বলা হয়েছে উপনিষদে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হচ্ছে-“সা চেদস্মৈ ন দদ্যাৎ কামমনোমবক্রীণীয়াৎ সা চৈদস্মৈ নৈব দদ্যাৎকামমেনাং যষ্ট্যা পাণিনা বোপহত্যাতিক্রামেদিন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশআদদ ইত্যযশা এব ভবতি।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬/৪/৭)সরলার্থঃ যদি সেই স্ত্রী এই পুরুষকে কামনা না যোগায় তবে সে সেই স্ত্রীলোককে উপহারাদি দ্বারা বশীভূত করিবে। তাহাতেও যদি সে পুরুষের কামনা চরিতার্থ না করে তবে সেই স্ত্রীকে সে হাত বা লাঠি দ্বারা আঘাত করিয়া বলিবে-‘আমি ইন্দ্রিয়রূপ যশদ্বারা তোমার যশ গ্রহণ করিতেছি।‘ এই বলিয়া তাহাকে বশীভূত করিবে।ইহাতে সেই স্ত্রী যশোহীনা হইবে।” [হরফ প্রকাশনী]নারীর সাথে এমন ব্যবহারকারী পুরুষ আজকের যুগে ঋষি হিসাবে পূজিত হত না বরং কারাগারে তার ঠাই হত। তথ্যসূত্র ও টীকা- [1] It so happened, however, that the handsome Varuna had, from a long time before, coveted the girl. Coming to the woods where Utathya dwelti Varuna stole away the girl when she had plunged into the Yamuna for a bath. Abducting her thus, the Lord of the waters took her to his own abode. That mansion was of wonderful aspect. It was adorned with six hundred thousand lakes. There is no mansion that can be regarded more beautiful than that palace of Varuna. It was adorned with many palaces and by the presence of diverse tribes of Apsaras and of diverse excellent articles of enjoyment. There, within that palace, the Lord of waters, O king, sported with the damsel. A little while after, the fact of the ravishment of his wife was reported to Utathya. [ Mahabrahata/Anushasana Parva/ 154, Translated by Pratap Chandra Roy][2] ”…Surya Deva said :– “O Kunti! What for you called me, by virtue of the Mantra? Calling me, why do you not worship me, standing before you? O beautiful blue one! Seeing you, I have become passionate; so come to me. By means of the mantra, you have made me your subservient so take me for intercourse.” Hearing this, Kunti said:– “O Witness of all! O knower of Dharma! You know that I am a virgin girl. O Suvrata! I bow down to you; I am a family daughter; so do not speak ill to me.” Surya then said :– “If I go away in vain, I will be an object of great shame, and, no doubt, will be laughed amongst the gods; So, O Kunti! If you do not satisfy me, I will immediately curse you and the Brahmin who has given you this mantra. O Beautiful one! If you satisfy me, your virginity will remain; no body will come to know and there will be born a son to you, exactly like me.” Thus saying Surya Deva enjoyed the bashful Kunti, with her mind attracted towards him; He granted her the desired boons and went away. The beautiful Kunti became pregnant and began to remain in a house, under great secrecy. Only the dear nurse knew that; her mother or any other person was quite unaware of the fact. In time, a very beautiful son like the second Sun and Kartikeya, decked with a lovely Kavacha coat of mail and two ear-rings, was born there.” [ Devi Bhagavatam 2.6.13-35 Translated by- Swami Vijnananda][3] স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২০/২২-৩১[4] স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২০/২২-৩১[5] স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২১/১-৫[6] স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২১/১৯-৩১[7] স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২১/১৯-৩১[8] স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২১/১৯-৩১[9] মহাভারত/আদি পর্ব/ দ্বধিকশততম (১০২) অধ্যায়[10] ভারতে বিবাহের ইতিহাস, লেখক- অতুল সুর[11] ভারতে বিবাহের ইতিহাস, লেখক- অতুল সুর[12] কালিপ্রসন্নসিংহের মহাভারত/ আদিপর্ব/ ১২০-১২১ অধ্যায়
Comments